কোয়ান্টাম কালচার এবং বিজ্ঞান ও ইসলাম

আচ্ছা, আপনি কি “কোয়ান্টাম” শব্দটি শুনেছেন? যদি শুনে থাকেন তবে নিশ্চয়ই ভাবছেন যে আমি এখনই “কোয়ান্টাম মেকানিক্সের” কথা বলব। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। শিরোনামে কোয়ান্টাম শব্দটি থাকলেও আমার এই লেখার বিষয়বস্তু কিন্তু “কোয়ান্টাম মেকানিক্স” নয় বরং “কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন”। যারা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের নাম শুনেছেন তাদেরকে তো আর এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আর যারা এর নাম শোনেননি বা এই ফাউন্ডেশন সম্পর্কে যাদের কোন ধারণা নেই- তাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এই লেখাটি পড়তে থাকুন – আশাকরি জানতে পারবেন। মনে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে এই ফাউন্ডেশন নিয়ে এত বড় লেখা লিখার কী দরকার ছিল। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বেশ কিছু ব্যাপার আমার কাছে গড়বর লাগছে। এত বেশি গড়বর লাগছে যে ব্যাপারগুলো আমার জন্য হজম করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে, এই লেখাটি সেই বদহজমেরই ফলাফল।

লেখার শুরুতেই কিছু ব্যাপার খোলসা করে বলে ফেলি। আমি বিজ্ঞানপ্রিয় একজন মানুষ, কোন বিজ্ঞানী নই। তাই একজন বিজ্ঞানীর চেয়ে আমার বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান অনেক কম হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি আস্তিক এবং ধর্মবিশ্বাসে মনেপ্রাণে একজন মুসলিম, চেষ্টা করি জীবনের সব ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলতে, তবে আমি কোন মুসলিম পন্ডিত নই কিংবা ইসলাম নিয়ে আমার অগাধ জ্ঞান নেই। আমার এই লেখায় বিজ্ঞান ও ইসলাম নিয়ে যা কিছু চলে এসেছে তার সবই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর এই সীমাবদ্ধতাকে পাকপোক্ত করার জন্য বিভিন্ন রেফারেন্স ও ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে রেফারেন্সগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে নাম্বার দিয়ে রেফারেন্সগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। মিলিয়ে দেখার সুবিধার জন্য রেফারেন্সগুলো তালিকা আকারে ডান পাশে ও উপরের মেনুতে উল্লেখ করা আছে। আর লেখায় ব্যবহৃত কোয়ান্টাম মেথড সংক্রান্ত সকল তথ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট [১] এবং তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন বই [২][৩] থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সবগুলো বইয়েরই সর্বশেষ সংস্করণ ব্যবহার করা হয়েছে.

বিজ্ঞান

আমার এই ছোট্ট জীবনে বিজ্ঞান বেশ বড়সর একটা জায়গা দখল করে আছে। বিজ্ঞানের সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে – হোক সেটা ডিনামিক্সে দেয়া নিউটনের মূলসূত্রগুলো কিংবা আইনস্টাইনের থিউরি অফ রিলেটিভিটি অথবা এডিসনের তৈরি ইলেক্ট্রিক বাল্ব। বড় বিজ্ঞান ছোট বিজ্ঞান – সবকিছুতেই মুগ্ধ হতে সময় লাগেনা। বাতাসভর্তি বেলুনকে ফাটালে শব্দ হয় – বেলুনের ভেতর কোন বোমা না থাকার পরও কেন শব্দ হয় সেই ব্যাখ্যা পেয়ে আমি মুগ্ধ হই। পানিতে টইটুম্বুর একটা গ্লাসের মুখে কাগজ চেপে গ্লাস উল্টালে পানিও পড়েনা কাগজও পড়েনা – দেখে আমি মুগ্ধ হই। জগদীশচন্দ্র বসু প্রমান করলেন গাছেরও প্রাণ আছে – জেনে আমি মুগ্ধ হই। আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, সুব্রত বড়ুয়া আর মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা বিজ্ঞানবিষয়ক ছোটদের বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হই। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমনকি বিজ্ঞানী দেখেও মুগ্ধ হই। মোদ্দা কথা বিজ্ঞান আমাকে যেরকম মুগ্ধ করে আর কোন কিছুই সেভাবে আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনা। যারা বিজ্ঞান বোঝেন তারা নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের নানা কলাকৌশল দেখে আমার মতই মুগ্ধ হন – কেউ কম মুগ্ধ হন আবার কেউবা বেশি মুগ্ধ হন – কিন্তু মুগ্ধ যে হন এটা নিশ্চিত! মুগ্ধ হয়ে বিজ্ঞানকে আরো মহিমান্বিত করার চেষ্টাও করেন অনেকে, বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে চান মানুষের কাছে।

অবশ্য সবাই যে বিজ্ঞানকে নিয়ে এভাবে ভাবেন তাও কিন্তু নয়, এর বিপরীত অবস্থাও দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে বিজ্ঞান বিষয়টি এখনও সেরকমভাবে জনপ্রিয় হতে না পারলেও “বৈজ্ঞানিক” শব্দটি কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই কেউ “বৈজ্ঞানিক” পদ্ধতিতে মাত্র সাত দিনে ইংলিশ শিখিয়ে দিচ্ছে, কেউবা “বৈজ্ঞানিক” পদ্ধতিতে ভাগ্যগণনা করে ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছে আবার কেউ “বৈজ্ঞানিক” পদ্ধতিতে জীবনে সুখ আনবার ট্রেনিং দিচ্ছে। চারপাশে অবৈজ্ঞানিক সব ব্যাপারস্যাপারকে যেভাবে “বৈজ্ঞানিক” শব্দটির মোড়কে ঢেকে ফেলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তা হাতে গছিয়ে দেয়া হচ্ছে – বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষ হয়ে আমার জন্য সেটা হজম করা বেশ কষ্টকর।

নিশ্চয়ই বৃত্তান্ত শুনতে ইচ্ছা করছে যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্কটা কি? বৃত্তান্ত দেবার আগে কিছু বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বলি, তাহলে পরের কথাগুলো বুঝতে সুবিধা হবে আপনার জন্য প্রথমেই আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে শুরু করি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স

প্রথমেই শুরু করি কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স মোটেও সহজ ব্যাপার না, বাঘা বাঘা লোকজনও এই থিওরি বুঝতে গিয়ে ঘোল খায়। এর এই কঠিন দিক নিয়ে রসবোধে বরপুর বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান রসিকতা করে বলেছিলেন, “I think I can safely say that nobody understands quantum mechanics.”[৪] সহজ ভাষায় কোয়ান্টামতত্ত্ব লেখা মোটেও চাট্টিখানি কথা না। এ কারণে সহজ ভাষায় সবার বোধগম্য করে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য প্রয়াত কথা শিল্পী হুমায়ুন আহমেদের লেখা “কাঠপেন্সিল” বইটির [৫] উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

এমন একটা সময় ছিল যখন পদার্থ বিজ্ঞানই ছিল মূল বিজ্ঞান, আর পদার্থ বিজ্ঞানের মূল ব্যাপার-স্যাপারগুলো এসেছিল আইজাক নিউটনের সূত্র ধরে। সেটাকে বলা হত ক্লাসিকাল মেকানিক্স। সবকিছু সেসব সূত্র মেনেই চলছিল। একসময় ধারণা করা হল যে পদার্থবিদ্যার সবকিছুই আবিষ্কার হয়ে গেছে, নতুন আর কিছুই আবিষ্কার করার নেই। পুরো পদার্থবিদ্যা জগতে নেমে এল স্থবিরতা। পদার্থবিদ্যা বাদ দিয়ে লোকজন জীববিজ্ঞান, রসায়ন – এইসব ব্যাপার নিয়ে মেতে উঠল। পদার্থবিদ্যার যখন এই অবস্থা তখন হঠাৎ দেখা গেল যে পদার্থবিদ্যার বেশ কিছু জিনিস ক্লাসিকাল মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছেনা। যেমন ইলেক্ট্রনের আচরণ। আর সেরকম এক সময়ই ম্যাক্সপ্ল্যাংক কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে এক বিদ্যা তৈরি করে ফেললেন। এর মধ্যে হাইজেনবার্গ তাঁর বিখ্যাত “অনিশ্চয়তার সূত্র”টি দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যে কোন বস্তুর গতি ও অবস্থান কখনোই একসাথে বের করা যাবেনা, কিছু অনিশ্চয়তা থাকবেই। এই অনিশ্চয়তা কতটুকু তাও তিনি বের করে দিলেন। আইনস্টাইন সে সময় খুব বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, সব বস্তু যেহেতু প্রকৃতির মাঝে রয়েছে তাই প্রকৃতি সব বস্তুর বেগ ও অবস্থান জানে, প্রকৃতিতে কোন অনিশ্চয়তা নেই। কাজেই আমাদের উপর কোন অনিশ্চয়তা নেই। এ সময়ই আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেন – “ঈশ্বর পাশা খেলেন না (God does not play dice)”। তিনি উঠে পড়ে লাগলেন “অনিশ্চয়তার সূত্র” ভুল প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি থিওরিটিকে আরো পাকা পোক্ত করে ফেলেন। নিলস বোর তাঁকে দেখিয়ে দেন যে কিভাবে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। আইনস্টাইন বাধ্য হয়ে সূত্রটির যথার্থতা স্বীকার করলেও, তিনি কোয়ান্টাম থিওরি নিয়ে কখনোই পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে পারেননি।

আইনস্টাইনের মত কোয়ান্টাম থিওরি বাতিল প্রমাণ করার জন্য কাজ করছিলেন বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার। তিনি নিজে যদিও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জনকদের একজন (এবং তরঙ্গ সমীকরণ বা Wave Equation এর আবিষ্কারক), তারপরও পদার্থবিদ্যায় সম্ভাবনা (probability) ও অনিশ্চয়তার ব্যাপার তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেননা। তিনি এক কল্পিত এক্সপেরিমেন্টের কথা বললেন। সেই এক্সপেরিমেন্টে একটি বেড়াল আছে একটি বাক্সের মধ্যে, যে বাক্সে রয়েছে এক বোতল বিষাক্ত গ্যাস, বোতলের উপর একটা হাতুরি, হাতুড়িটা আবার একটা গিগার কাউন্টারের (যা দিয়ে তেজষ্ক্রিয়তা মাপা হয়) সাথে যুক্ত, কাউন্টারটির পাশেই রয়েছে একটুকরো তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম। ধরা যাক, ৫০% সম্ভাবনা যে ইউরেনিয়াম অ্যাটম এক সেকেন্ড পর ভেঙ্গে যাবে। সাথে সাথেই গিগার কাউন্টারটি সচল হবে, ফলে হাতুরি আছড়ে পড়বে বোতলে, শুরু হবে বিষক্রিয়া। এখন এই ঘটনার ফলে বাক্সের ভেতর বেড়ালটি বেঁচে আছে কি মারা গেছে – এ প্রশ্নের সাধারন কোন উত্তর নেই, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেড়ালটি বেঁচেও আছে আবার মারাও গেছে – এই দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান। অর্থাৎ একটি বিড়ালের দুটি wave function থাকবে। বাক্স না খোলা পর্যন্ত আমরা বলতে পারছিনা যে বিড়ালটি জীবিত না মৃত। বাক্স খুললেই কেবল তা জানা সম্ভব, আর তখনই বিড়ালের wave function collapse করবে। শ্রোডিঙ্গারের কাছে ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর ছিল। তিনি বললেন, আমরা যখন দেখব তখনই বিড়ালের ভাগ্য নির্ধারিত হবে, তার আগে না – এ কেমন কথা?

এই বার নোবেলবিজয়ী পদার্থবিদ ইউজিন উইগনার এগিয়ে এলেন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যার সমাধানে। তিনি বললেন যে, “চেতনাই বস্তুর অবস্থানের নিয়ন্তা (Consciousness determines the existense)”। কার চেতনা? যে ঘটনাটি দেখছে তার চেতনা, অর্থাৎ Observer এর চেতনা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম – যদি Observer এর মধ্যে চেতনা থাকে থাকে তবেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা চলে আসে। সমস্যা দেখা দিল যখন চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করতে যাওয়া হল তখন। কারণ পদার্থবিদ্যায় চেতনার কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। পদার্থবিদ্যা চেতনা নিয়ে কাজ করেনা, এটা মনোবিজ্ঞানের বিষয়। বেশিরভাগ ভৌত বিজ্ঞানীরা আবার মনোবিজ্ঞানকে পাত্তা দেননা।[৬] কারণ তাদের মতে মনোবিজ্ঞানে কোন কিছুরই সেরকম কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যেমন ধরুণ – “সুখ”। আপনি কিভাবে সুখকে সংজ্ঞায়িত করবেন? কারণ এই জিনিসটা নিয়ে একেকজনের অনুভূতি একেক রকম – এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তাছাড়া এর কোন পরিমাপও নেই। এক কেজি সুখ বা দুই মিটার সুখ – এভাবে কি সুখকে মাপা যায়? সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও পরিমাপ ছাড়া বিজ্ঞান কাজ করেনা। যার ফলে দেখা যায় যে মনোবিজ্ঞান সত্যিকারের বিজ্ঞান কীনা সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রায়ই তর্কবিতর্ক চলে – সে আরেক মজার কাহিনী!

যাই হোক, আগের কথায় ফেরত আসি। চেতনাকে যখন সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছেনা, তখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করলেন যে চেতনা ব্যাপারটা নেই এমন থিওরি দিতে। এবং তারা সমস্যার একাধিক সমাধানও করে ফেললেন। এই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের বিষয়টা বেশ কিছু কোয়ান্টাম ইন্টারপ্রেটেশন থেকে এসেছে, এর মধ্যে কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশন খুব বিখ্যাত। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রেটেশনে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সের কথা বলা আছে ঠিকই কিন্তু ঠিক কী বা কে “অবজার্ভার” হিসেবে বিবেচিত হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা নেই। সুতরাং তিনি শুধুমাত্র “কনসাস অবজারভার (conscious observer)” ইন্টারপ্রেটেশনটি বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে নীলস বোরসহ অনেকেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সকে শুধু প্রতীকী উপস্থাপনা বলে আখ্যায়িত করেছেন।[৭] শেষমেষ ইউজিন উইগনার নিজেই চেতনার ব্যাপারস্যাপার থেকে সরে দাঁড়ান। [৮]

এদিকে জার্মান পদার্থবিদ ডিটিয়ার বেন বিড়াল সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে বলেন যে জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আর মৃত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন আলাদা থাকবে, একটির সাথে অন্যটির কোন যোগ থাকবেনা। ফলে কোন অবজার্ভারের দরকার পড়বেনা। হিউ এভার্ট লিখলেন যে শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সাথে জীবিত ও মৃত, কারণ জগৎ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে, এক জগতে বিড়াল মৃত অন্য জগতে বিড়াল জীবিত। জগৎ দুটি একই জায়গায় একই সময়ে হলেও তারা সম্পূর্ণ আলাদা। জগৎ যদি ভাগই হয় তবে দুটো ভাগে কেন ভাগ হবে? আরো বেশি ভাগেই ভাগ হয়ে যাক! তৈরি হল মাল্টিভার্স থিওরি, যেখানে একইসাথে একাধিক জগৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়।

আমি বরং আর না এগোই। কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে নিশ্চয়ই মাথায় এতক্ষণে কঠিন প্যাচ লেগে গেছে? তো এই হচ্ছে অতি সংক্ষেপে অতি সহজ ভাষায় কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ঠিকমত বুঝতে বা বুঝাতে হলে অংকের সাহায্য নিতেই হবে, এখানে অংক প্রয়োগের সে সুযোগ নেই বলে কোয়ান্টাম থিওরিকে অতি সরল লাগলেও লাগতে পারে।

কোয়ান্টাম মেথড

প্রথমেই বেসিক প্রশ্ন – কোয়ান্টাম মেথড কি? তাদের ভাষ্যমতে এককথায় এটি – “Science of Living”. আশ্রম ও খানকার চৌহদ্দি থেকে বের করে ধ্যানকে গণমানুষের আত্মউন্নয়ন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রয়োগ করাই তাদের উদ্দেশ্য।[৯] ধ্যানচর্চার মাধ্যমে প্রাচ্যের সাধনা আর আধুনিক বিজ্ঞানের নির্যাসে সঞ্জীবিত কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন প্রক্রিয়া। সাধকদের সাধনা ও মনোবিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার সমন্বয়ের ফলে সহজে মেডিটেটিভ লেভেলে পৌছে আত্মনিমগ্ন হওয়া যায়।[১০] সোজা কথায় ধ্যান চর্চার মাধ্যমে জীবনযাপনের বিজ্ঞান এটি।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম মেথড

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের এই “কোয়ান্টাম” নামটি কিন্তু এসেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকেই। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভাষ্য হচ্ছে –

কোয়ান্টাম শব্দটি নেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স থেকে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আগে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত হতো নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে। আমরা জানি, বিজ্ঞানী নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েলের সূত্র অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞান ঊনবিংশ শতাব্দির শেষভাগে এক সুশৃঙ্খল বিশ্বদৃষ্টি উপস্থাপন করে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছুই ছিলো এক নিয়মের অধীন, সবকিছুই হিসেব করে বলে দেয়া যেত। সেখানে বিজ্ঞানীর কোনো ভূমিকা থাকলো না। বিজ্ঞানী ছিলেন একজন দর্শকমাত্র। আর পুরো প্রক্রিয়া হচ্ছে দর্শক-মন নিরপেক্ষ। অর্থাৎ মনের কোনো ভূমিকা আর থাকলো না। বিজ্ঞান থেকে মন নির্বাসিত হলো এবং বস্ত্তবাদের বিকাশ ঘটলো। [১১]

পরমাণু পর্যন্ত নিউটনিয়ান মেকানিক্স ভালোভাবেই সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হচ্ছিলো। কিন্তু বিজ্ঞান যখন পরমাণুর গভীরে বা সাব-এটমিক লেভেলে ঢুকলো তখন দেখা গেল, একটা সাব-এটমিক পার্টিকেল-পার্টিকেল ফর্মে আছে, না এনার্জি ফর্মে আছে তা হিসেব করে বলা যাচ্ছে না, দেখে বলতে হচ্ছে। যেকোনো সময় এটা পার্টিকেল ফর্মে থাকতে পারে, যেকোনো সময় এটা এনার্জি ফর্মে থাকতে পারে। এটাই হলো ওয়ার্নার হেইজেনবার্গের আনসারটেইনিটি প্রিন্সিপল। বিজ্ঞানে তখন আবার দর্শকের আগমন ঘটলো।[১১]

কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিংশ শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে আবার বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করে। যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞান থেকে নির্বাসিত মনকে বিজ্ঞানে পুনর্বাসিত করে, তাই চেতনার শক্তিকে, মনের বিশাল ক্ষমতাকে নিজের ও মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের সহজ ও পরীক্ষিত এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটির নামকরণ করা হয়েছে কোয়ান্টাম মেথড। [১১]

মন ও চেতনার ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সার-সংক্ষেপ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তাঁর ‘Remarks on the Mind-Body Question’ নিবন্ধে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, অধিকাংশ পদার্থ বিজ্ঞানীই এই সত্যকে মেনে নিয়েছেন যে, চিন্তা অর্থাৎ মনই হচ্ছে মূল। ‘চেতনার উল্লেখ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর নিয়মকে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা সম্ভব নয়।’ নিবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানী উইগনার বলেছেন, ‘বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত চেতনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’ [১২]

যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স কি বা এটা কি ধরণের থিওরির কথা বলে – এসব ব্যাপারে কোন আলোচনা করেনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। তবে দেখা যাচ্ছে যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে যেহেতু চেতনার বা মনের একটা কনসেপ্ট ঢুকেছিল সে জন্য কোয়ান্টাম মেডিটেশনকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। এবং একারণেই এই ধ্যানচর্চার নামকরণ করা হয়েছে – কোয়ান্টাম মেডিটেশন। এটা ছাড়া কেয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে এর কোনই সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ অনিশ্চয়তার সূত্র বা মাল্টিভার্স থিওরি বা অন্য কোন কিছুর সাথে এর কোনই যোগাযোগ নেই!

আমরা একটু আগেই পড়েছিলাম, বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনারের হাত ধরেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে “চেতনা” জিনিসটার আগমন ঘটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই চেতনার ব্যাপারটি থেকে ইউজিন উইগনার নিজেই সরে দাঁড়ান।[৮] শুধু তাই নয়, শ্রোডিঙ্গারের থট এক্সপেরিমেন্টে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্সে কনসাস অবজারভারের ভূমিকার প্রয়োজনই নেই এমনটা পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে বাক্সে রাখা গিগার কাউন্টারই যথেষ্ট ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স করাতে সেখানে দর্শক বা চেতনা বা মন দরকার পড়বে না।[১৩] তাছাড়া, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি বহুল পরিচিত ইন্টারপ্রেটেশন হচ্ছে মেনি-ওয়ার্ল্ড ইন্টারপ্রেটেশন বা মাল্টিভার্স ইন্টারপ্রেটেশন। এই ইন্টারপ্রেটেশনে ওয়েভ ফাংশন আদৌও কলাপ্স হয়না বলা হয়েছে। এই ইন্টারপ্রেটেশনের পক্ষে অনেক বিখ্যাত পদার্থবিদকেই দেখা যায়, তাদের মধ্যে আছেন স্টিফেন হকিং, ভাইনবার্গ প্রমুখ[১৪]। আরও আছে অবজেক্টিভ কলাপ্স থিওরি, এ থিওরিতে বলা হয়েছে চেতনা নয় বরং বিড়াল নিজেই নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে। এর অর্থ হল বিড়াল একটা নিশ্বাস নিলো, অতিক্ষুদ্র হলেও তার ভর বাড়ল সুতরাং ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। নিঃশ্বাস ছাড়ল? সাথে সাথে ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স। তাপমাত্রা পরিবর্তন হল? সাথে সাথে কলাপ্স! অর্থাৎ কোন মন বা চেতনা সম্পন্ন দর্শকের বাক্স খুলে বিড়াল দেখার আগেই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স হয়ে বসে আছে! [১৫]

তো আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে দাবী করছে যে চেতনাই কোয়ান্টাম থিওরির সবকিছু, আসলে ব্যাপার সেটা না। উপরন্তু এই চেতনা জিনিসটা ভৌতবিজ্ঞানের কিছু না হওয়াতে এবং একে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়না দেখেই কোয়ান্টাম বিশ্বে চেতনাকে বাদ দেবার জন্য অনেক থিওরি তৈরি ও প্রমানিত হয়। চেতনা নামের জিনিসটাই ছাড়াই বেশ ভালোভাবেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবকিছু চলছে।

অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন শুধু চেতনাই না, মানুষের মনকে ইলেক্ট্রনের সাথেও তুলনা করেছে। মন কিভাবে ইলেক্ট্রনের সাথে তুলনীয় হতে পারে সেটা অবশ্য বোধগম্য নয়। তাদের কথানুযায়ী –

তাছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে একটি ইলেকট্রন যখন তার কক্ষপথে ঘোরে, তখন ঘুরতে ঘুরতে আস্তে আস্তে কেন্দ্রের দিকে নামতে শুরু করে। এরই একপর্যায়ে সে একটা উচ্চতর কক্ষপথে লাফ দেয়। খুব দ্রুত ঘটা এ উচ্চস্তরে উত্তরণ বা উত্থানকে বলা হয় কোয়ান্টাম লিপ বা কোয়ান্টাম উল্লম্ফন। তেমনি একজন মানুষ যখন ধ্যান করে, আত্মনিমগ্নতার গভীরে চলে যায়, তখন তার মধ্যেও একটা উপলব্ধির স্ফূরণ ঘটে, যা তাকে আগের চেয়ে উন্নততর মানসিক ও আত্মিক স্তরে নিয়ে যায়। কোয়ান্টাম লিপের মতো তার চেতনার জগতেও একটা উল্লম্ফন হয়। কোয়ান্টাম মেথড নামকরণের এটাও একটা কারণ।[১৬]

ভালকথা যে ইলেক্ট্রন উচ্চতর শক্তিস্তরে লাফ দেয়, যাকে এখানে উত্থানের সাথে তুলনা করা হয়েছে। পরের লাইনগুলোতে যা বলা হয়েছে যে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে যে, ধ্যানেও নাকি লোকজনের এই রকম আত্মিক উত্থান ঘটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, ইলেক্ট্রন শুধু উচ্চ শক্তিস্তরেই লাফ দেয়না বরং নিম্ন শক্তিস্তরেও লাফ দেয়।[১৭] ইলেক্ট্রনের উচ্চস্তরে লাফানোকে উত্থান বলা হলে, নিম্নস্তরে লাফানোকে নিশ্চয়ই পতন বলা হবে। তো সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? ধ্যানে লোকজনের আত্মিক পতনও ঘটে?

সোজা কথা, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে কোয়ান্টাম মেথডের কোন সম্পর্কই নেই। ইনফ্যাক্ট বিজ্ঞানের সাথেই এর কোন সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র চটকদার নাম নেবার জন্য “কোয়ান্টাম” শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আমার ধারণা। যদিও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবী করে যাচ্ছে যে এটা নাকি বিজ্ঞান-

তাই আমরা কোয়ান্টামকে বলি জীবনযাপনের বিজ্ঞান, সফল জীবনের বিজ্ঞান।[১৬]

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের লোগোতেও লেখা আছে – “Science of Living”। কিন্তু এখানে বিজ্ঞানের কোন ব্যাপারটা আসলো, যার কারণে একে আমরা বিজ্ঞান বলব, সেটাই বুঝলাম না! কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে তো বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিছু হচ্ছেনা, কোন গবেষণা হচ্ছে না। কেবল মেডিটেশন হচ্ছে। তাহলে কি বলব যে ধ্যান করাটা বিজ্ঞান? কিন্তু কেন? ধ্যানকে তো মাপজোখ করা যাচ্ছেনা। কোন গানিতিক সূত্র দিয়ে একে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছেনা। তবে কেন কোয়ান্টাম মেথড বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক কিছু একটা হবে?

কোয়ান্টাম মেথড ও টেলিপ্যাথি

টেলিপ্যাথি কি? সংক্ষেপে, এ হলো কোনো রকম মাধ্যম ছাড়া দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে চিন্তার ট্রান্সমিশন। অর্থাৎ আপনার ভেতর যে চিন্তা খেলা করছে তা আরেকজনের কাছে কোন মাধ্যম (কাগজ, বই, চিঠি, ফোন ইত্যাদি) ছাড়াই পাঠিয়ে দেয়া, যেভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার কে আপনি আপনার কথাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেন। বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনে এই ব্যাপারটার অস্তিত্ব থাকলেও সত্যিকারের বিজ্ঞানে কিন্তু এর কোন স্বীকৃতিই নেই।[১৮][১৯][২০][২১] টেলিপ্যাথিকে গুরুত্ব দেন মনোবিজ্ঞানীদের একটি বিশেষ দল যাদেরকে বলা হয় প্যারাসাইকোলজিষ্ট। প্যারাসাইকোলজি[২২] অনুসারে টেলিপ্যাথি হলো এক প্রকার অতীন্দ্রিয় অনুভূতি, একস্ট্রা সেনসরি পারসেপশন বা সংক্ষেপে ইএসপি[১৮]।

প্যারাসাইকোলজিষ্টরা চিন্তাকে তরঙ্গ (frequency) হিসেবে দেখেন। তারা মনে করেন যে, যখনই কেউ চিন্তা করে তখন সে আসলে তরঙ্গ তৈরি করে। আর মানুষ ঐ তরঙ্গের প্রেরকযন্ত্র (ট্রান্সমিটার) ও গ্রাহকযন্ত্র (রিসিভার) হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। কাজেই, ফ্রিকুয়েন্সি মিললে একজনের ভাবনা আর একজনের কাছে পৌঁছে যাবে। অনেকটা রেডিও, টিভি বা মোবাইল ফোনের মত। রেডিও স্টেশন থেকে আসলে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি পাঠানো হয়, আপনার হাতের রেডিওটি তখন সেই ফ্রিকোয়েন্সি রিসিভ করলে আপনি সেই স্টেশনটির পাঠানো যেকোন বার্তা শুনতে পারবেন। যাই হোক, এই ধরনের চিন্তা তরঙ্গের কোনো অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। আর মানুষের মাথা যে এরকম কোন রিসিভার নয়, তার বড় প্রমাণ আপনি নিজে। কারণ, প্রতি মুহূর্তে আপনার চারপাশে বিস্তর তথ্য মাইক্রোওয়েভে বা রেডিওওয়েভে এদিক ওদিক যাচ্ছে। অথচ আপনার মাথার রিসিভারের এন্টেনা এ সবের কিছুই ধরতে পারছে না।

তবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবী করে যে এরকম টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করা সম্ভব[২৩]। শুধু তাইনা তাদের মতে মানুষের ব্রেন হচ্ছে চিন্তার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার[২৪]। এর একটা অদ্ভুত ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে-

প্রতিটি মন হচ্ছে বিশ্বমন নামক এক সুপার সুপার সুপার কম্পিউটাররূপী মহাজাগতিক জ্ঞানভান্ডারের (Cosmic information super highway) এক একটি টার্মিনাল। সুপার কম্পিউটারের যতগুলো টার্মিনালই থাকুক না কেন, যে কোন টার্মিনাল থেকে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে বা সুপার কম্পিউটারের কেন্দ্রের সাথে যেমন যোগাযোগ করা যায়, তেমনি মন ধ্যানের স্তরে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি সৃষ্টি হলে বিশ্বমনরূপী মহাজাগতিক জ্ঞানভান্ডারের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত তথ্য লাভ করে।[২৫]

Cosmic information super highway জিনিসটা কোথায় আছে বা কিভাবে আছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই বইটিতে। শুধু যে বইটিতে ব্যাখ্যা নেই তাই না, মহাজ্ঞানী Google ও এর সঠিক কোন হদিস দিতে পারেনি। তবে যদি ধরেও নেই যে এই ধরণের একটা কম্পিউটার রয়েছে, তারপরও আমরা বেশ সমস্যায় পড়ব। সমস্যাটা হবে এই কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আমাদের চিন্তার ফ্রিকোয়েন্সি কত সেটা নিয়ে কোন ব্যাখ্যা নেই বইটিতে। তবে ব্রেন ওয়েভের কথা বলা হয়েছে[২৪], যা আদতে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের বিভিন্ন নিউরাল অ্যাক্টিভিটির কাজ করার ছন্দকে প্রকাশ করে[২৬], এর সাথে চিন্তা তরঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া ব্রেইনওয়েভের যে ফ্রিকোয়েন্সি উল্লেখ করা আছে (সর্বোচ্চ ২৭ হার্জ বা তার বেশি, সর্বনিম্ম ০.৫ হার্জ) তা দিয়ে তারছাড়া (wireless) যোগাযোগ একেবারেই সম্ভব না। সফলভাবে ওয়্যারলেস যোগাযোগের জন্য সর্বনিম্ম যে ফ্রিকোয়েন্সি দরকার তা হল ৩০০০ হার্জ[২৭]। এর চেয়ে কম হলে যোগাযোগ করা খুবই কষ্ট হয়ে পড়বে। যার কারণে এর চেয়ে নিচে কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করা হয়না। তাছাড়া আমরা যখন যোগাযোগের জন্য কোন সিগনাল পাঠাই তখন সেটাকে মডুলেশন নামে একটা পদ্ধতির মাধ্যমে পাঠাই। আমাদের গলার স্বরের ফ্রিকোয়েন্সি মোটামুটি ৪০০০ হার্জ। এটা খুব দুর্বল ফ্রিকোয়েন্সি বিধায় একে একটা শক্তিশালী ফ্রিকোয়েন্সির উপর চাপিয়ে পাঠানো হয়। এই পদ্ধতিটির নামই হচ্ছে মডুলেশন। মোবাইল ফোন বা রেডিও – সব কিছুই এই পদ্ধতিটি মেনে চলে। যে কারণে আমাদের খালি গলার আওয়াজ খুব অল্প দুরত্ব পর্যন্ত শোনা গেলেও, রেডিও বা ফোনে সেটাকে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া বা তার চেয়েও দুরত্বে শোনা যায়। মডুলেশনের কয়েকটি বহুলব্যবহৃত ভাগের নাম অবশ্য সবারই জানা – অ্যাম্প্লিচিউড মডুলেশন (এএম) ও ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন (এফএম)। এএম রেডিও বা এফএম রেডিওতে এসব মডুলেশন ব্যবহার করা হয়। তাই এর চেয়ে কম ফ্রিকোয়ন্সিতে কেউ কোন মাধ্যম ছাড়া যোগাযোগ করছে, তাও আবার মডুলেশন পদ্ধতি ছাড়া – এই অযৌক্তিক ব্যাপারটা বিজ্ঞান কখনোই মেনে নিতে পারেনা।

অবশ্য বইটিতে টেলিপ্যাথির সফল প্রয়োগের একটা উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে-

অ্যাপোলো-১৪-এর নভোচারী এডগার মিচেল চন্দ্র পৃষ্ঠ থেকে ভূ-নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিউস্টনের সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই যোগাযোগ এত সফল হয়েছিল যে, নভোচারী মিচেল ভূপৃষ্ঠে ফিরে এসে গড়ে তোলেন এক নতুন প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব নিইটিক সাইন্সেস।[২৫]

এডগার মিচেলের এই কাহিনী যে ধাপ্পা সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে বহু আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে[২৮]। অথচ এই ধাপ্পা কাহিনীটিকেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন টেলিপ্যাথির প্রমাণিত উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছে। সত্যিকারের বিজ্ঞানের কাছে টেলিপ্যাথি হচ্ছে অপবিজ্ঞান।

এবং চুম্বক পানি

চুম্বক এবং পানি – দুটোকেই আলাদাভাবে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারলেও, চুম্বকায়িত পানির কোন বৈজ্ঞানিক অস্তিত্ব নেই। তবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে এই অবৈজ্ঞানিক জিনিসটার বেশ কদর আছে। কদরের উদাহরণ-

পানীয়ের রাজা চুম্বক পানি। নিয়মিত চুম্বক পানি পানে হজম শক্তি ও ক্ষুধা বাড়ে, এসিডিটি হ্রাস পায়, আলসার ও মূত্রাশয়ের ব্যাধি নিরাময় হয়, গলব্লাডার ও কিডনিতে পাথরসহ দেহে অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু জমাট বাঁধতে পারে না।[২৯]

প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে কেন চুম্বকায়িত পানির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই? তার আগে আমরা দেখি যে চুম্বক নিয়ে বিজ্ঞান কি বলে। বিজ্ঞান বলে যে চুম্বকের চুম্বকত্বের কারণে চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। এই চুম্বক ক্ষেত্র অদৃশ্য কিন্তু এর মাধ্যমেই চুম্বকের প্রায় সব ধর্ম প্রকাশ পায়; এটা একটি বল যা তার চারপাশের ফেরোচৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং অন্য চুম্বককে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে। চুম্কবকে আকর্ষণ করতে হলে অন্য পদার্থকে অবশ্যই ফেরোচৌম্বক (Ferromagnetic) হতে হবে[৩০]। লোহা ফেরোচৌম্বক হলেও পানিকে নিয়ে হচ্ছে সমস্যা। এটি মোটেও ফেরোচৌম্বক নয়, যার কারণে চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করতে পারলেও পানিকে পারেনা। ফেরোচৌম্বক পদার্থে ছোট ছোট ম্যাগনেটিক ডোমেইন থাকে। এসব ডোমেইন বিভিন্নদিকে মুখ করে থাকে। বিভিন্ন দিকে মুখ করে রাখার করার কারণে এতে চৌম্বকত্ত্ব থাকেনা। কিন্তু ফেরোচৌম্বক পদার্থটিকে কোন চৌম্বক ক্ষেত্রে রাখলে ম্যাগনেটিক ডোমেইনগুলো উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু বরাবর একইদিকে মুখ করে থাকে। ফলে তখন পদার্থটি তখন চৌম্বকত্ত্ব দেখায়[৩১]। কিন্তু পানি ডায়াচৌম্বক (Diamagnetic) পদার্থ হবার কারণে চৌম্বকত্বের এই ধর্ম দেখায় না। শুধু তাইনা, পানির ম্যাগনেটিক সাসেপ্টিবিলিটি খুবই নগন্য, প্রায় নেগেটিভ ০.৯১। যার ফলে বলা যায় যে এর মাঝে কোন চৌম্বকত্ব নেই। যতটুকু আছে সেটা একেবারেই না থাকার সমান।[৩২]

অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে চুম্বকপানির পুরো প্রসেসটি বেশ সোজা, শুধু চুম্বকপানি ভর্তি বোতলে সাধারণ পানি রিফিল করলেই নতুন পানি চুম্বকপানি হয়ে যাবে –

এক বোতল চুম্বক পানি থেকে এক গ্লাস খেয়ে স্বাভাবিক এক গ্লাস পানি পুনরায় বোতলে ঢেলে রাখুন। চুম্বক পানির স্পর্শে নতুন পানিও চুম্বকায়িত হবে। এভাবে ৬ মাস অনায়াসে চালাতে পারবেন।[৩৩]

যেখানে বোতলে প্রথমবার রাখা পানির নিজেরই চৌম্বকত্ব নেই, সেখানে সে কিভাবে পরেরবার যোগ করা পানিকে চৌম্বক করে ফেলবে? আরো বড় কথা হল যে, বিজ্ঞান থেকেই দেখলাম যে চুম্বক দিয়ে পানির কোন গুনাগুনই পাল্টাচ্ছেনা, তাহলে চুম্বক পানি আর সাধারণ পানির মধ্যে পার্থক্য কি থাকল? আসলেই কোন পার্থক্য নেই। চুম্বকপানির নামে আসলে যা রয়েছে তা একদম সাধারণ পানি। মানুষের বিশ্বাস ও অজ্ঞতাকে পুঁজি করে চুম্বকপানির নামে সাধারণ পানি চালিয়ে দেবার এইসব ব্যাপার বেশ পুরনো[৩৪]।

তো সায়েন্স অফ লিভিং বা জীবন যাপনের বিজ্ঞান নিয়ে যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কাজ করার কথা বলছে, তারা আসলে বিজ্ঞানের কোন কিছুই অনুসরণ করছেনা। কোয়ান্টাম, কসমিক, সুপারহাইওয়ে, টেলিপ্যাথি, চুম্বক-পানি ইত্যাদি কিছু সায়েন্স ও সায়েন্স-ফিকশন টার্ম টেনে নিয়ে এসে অবৈজ্ঞানিক কোন কিছুকে বৈজ্ঞানিক বলে দাবী করার প্রয়াস অনেক পুরনো। সেজন্যই বলছিলাম যে বাংলাদেশে “বৈজ্ঞানিক” বেশ জনপ্রিয় একটি শব্দ। লোকজন বিজ্ঞান বুঝুক আর না বুঝুক, বিজ্ঞানের প্রতি তাদের চরম শ্রদ্ধা রয়েছে। তারা মনে করে কোন কিছুতে “বিজ্ঞান” শব্দটি থাকলে সেখানে ভুল কোন কিছু থাকতেই পারেনা। তাই চরম অবৈজ্ঞানিক ব্যপারেও “বৈজ্ঞানিক” বা “বিজ্ঞান” শব্দ বসিয়ে নিলে লোকজন তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যার কারণে বিজ্ঞানের ধারেকাছে না ঘেঁষে অপবিজ্ঞানকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কোয়ান্টাম মেথডকে লোকজন বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিনিয়ত ভুল করে যাচ্ছে।

ইসলাম ধর্ম

শুরুতেই বলে নেই, যারা মনে করেন যে বিজ্ঞান মানেই নাস্তিকতা, আমি তাদের দলে নই। আমি বিশ্বাস করি আমাদের চারপাশের মহাবিশ্বে যা যা ঘটছে বিজ্ঞান সেসবের নিয়মগুলো বের করে চলেছে। ঘটনাগুলো বিজ্ঞান ঘটাচ্ছেনা, নেপথ্যে অন্য কেউ রয়েছে। বিজ্ঞানী নিউটন বলের তিনটি সূত্র বের করে অমর হয়ে আছেন, কিন্তু সেই সূত্রগুলো কে তৈরি করেছে? বিজ্ঞানী ওহম একটা ইলেক্ট্রিক সার্কিটের মধ্যে কারেন্ট ও ভোল্টেজের মধ্যকার সম্পর্কটি বের করেছিলেন, কিন্তু সেই সম্পর্কটি তৈরি করেছিলই বা কে? এই মহাবিশ্বের সবকিছু যে নিয়ম মেনে ঠিকঠাকমত চলছে সেই নিয়মকানুনগুলো কে তৈরি করেছে? এভাবে চিন্তা করলে সবকিছু একজন সৃষ্টিকর্তাকেই স্মরণ করিয়ে। যে কারণে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন –

আমি নাস্তিক নই এবং আমি নিজেকে সর্বেশ্বরবাদেবিশ্বাসীও বলি না। আমরা আসলে ছোট্ট একটা শিশুর জায়গায় আছি যাকে বিশাল একটা লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ভাষায় রচিত বহু বই সাজিয়ে রাখা আছে। শিশুটি জানে যে এই বইগুলো অবশ্যই কেউ একজন লিখেছে। সে জানেনা যে কিভাবে লেখা হয়েছে। সে বইগুলোতে ব্যবহৃত ভাষাগুলোও জানেনা। শিশুটি অনুমান করছে যে বইগুলোকে সাজিয়ে রাখার ব্যপারে একটা রহস্যময় ব্যাপার আছে কিন্তু জানেনা যে সেটা কি। এটাই হচ্ছে আমার মতে স্রষ্টার প্রতি সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষটির আচরণ। আমরা একটা অসাধারণভাবে সাজানো গুছানো মহাবিশ্ব দেখি যা বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু সেসব নিয়মকানুনের খুব নগন্য অংশই আমাদের বোধগম্য। আমাদের সীমিত জ্ঞান এই মহাবিশ্বের পেছনের চালিকাশক্তিকে পুরোপুরি বুঝতে পারেনা।

সেজন্য আমি নিজেকে আস্তিক বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ধর্মবিশ্বাসে আমি একজন মুসলিম। আমি বিশ্বাস করি আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতা’লা। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স) তাঁর প্রেরিত প্রতিনিধি। বিশ্বের সিংহভাগ মুসলিমের মত আমিও একজন সুন্নি[৩৫]। সুন্নিদের মূল বৈশিষ্ট্য হল তারা জীবনের সবক্ষেত্রে রাসুল (স) এর জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করেন। সকল সুন্নিদের মত তাই আমিও বিশ্বাস করি আমাদেরকে কিভাবে চলতে হবে বা জীবন যাপন করতে হবে তার সবকিছুই কুরআন ও হাদীসে বলে দেয়া আছে।

এইবার নিশ্চয়ই ভাবছেন যে এত কিছু থাকতে কোয়ান্টাম মেথডের ভেতর ইসলাম ধর্ম কেন টেনে আনলাম? আসলে আমি টেনে আনিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নিজেরাই কোয়ান্টাম মেথডের মাঝে ইসলামকে টেনে এনেছেন[৩৬]। কারণ “বৈজ্ঞানিক” শব্দটির মতই আমাদের দেশের আরেকটি জনপ্রিয় শব্দ হল “ইসলাম”। মুসলিম ধর্মালম্বীর সংখ্যাগরিষ্ঠতার এ দেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই ধর্মভীরু। এই ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই যেকোন কিছুর গায়ে “ইসলামিক” বা “হালাল” – এইসব শব্দ চাপিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সেরে নিচ্ছে। এজন্য বাজারে “হালাল সাবান” কিংবা “ইসলামিক ফোন” দেখা যায়। মুদরাবার সব নিয়ম না মেনে চলা “ইসলামিক ব্যাংকিং” দেখা যায়। এসবের পাশাপাশি দেখা যায় “ইসলাম” লেবেল চাপানো বিভিন্ন পীরদের অবাধ ব্যবসার দৌরত্ম্য। নিজে জেনে-বুঝে ইসলাম পালন করার চেষ্টা এখন নিতান্তই ক্ষুদ্র ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাঝে সীমাবদ্ধ। তাই যেকোন মতবাদ, তা ইসলামের সাথে যতই সাংঘর্ষিকই হোক না কেন “ইসলামিকভাবে” প্যাকেট করে ধর্মভীরুদের সামনে তুলে ধরা হলে তা কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহনযোগ্য হয়ে পড়ে। এভাবে ধর্মভীরু মানুষদের ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে বিভ্রান্ত করার কৌশল অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।

আগেই বলেছি আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। আমার এই সীমিত জ্ঞানে বিদা’ত, কুফর ও শিরক নিয়ে যা বুঝি তাতে ইসলামের মূলনীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এমন অনেক কিছুই কোয়ান্টাম মেথডে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তবে তার আগে আমরা ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ের পর্যালোচনা করি। বিষয়গুলো পরিস্কার না হলে বক্তব্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়বে।

ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়

বিদআত

বিদআত প্রসঙ্গে আল্লামা ইব্রাহীম ইবন মুসা আল-শাতিবী বলেন:

বিদআত বলতে বুঝায় দ্বীনের মধ্যে শরীয়াতের পদ্ধতির তূল্য কোন নব-আবিষ্কৃত উদ্ভাবিত তরীকা বা পদ্ধতি, মহান আল্লাহর অতিরিক্ত ইবাদাতের আশায় যে পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়। [৩৭]

অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা অনুমোদন দিয়েছেন তা ব্যতীত নতুন কোন কিছু যোগ করাটাই হচ্ছে বিদআত। তারমানে এমন কোন ইবাদত না করা যা আল্লাহতা’লার রাসুল নিজেও করেননি এবং আমাদের করতে বলেননি। বিদআত অবশ্যই বর্জনীয়। বিদ’আত মূলত বর্জনের সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইবাদতের উদ্দীপনাতেই এর সৃষ্টি।

অনেকেই এক্ষেত্রে প্রশ্ন করে থাকেন যে আল্লাহর রাসূল এরোপ্লেনে চড়েননি, তাহলে কি প্লেনে চড়া বিদআত? আমাদের দেখতে হবে আল্লাহর রাসূলের এই বর্জন কি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত? এবং এটি ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট কীনা? বিদ’আত সবসময় ইচ্ছাকৃত বর্জন এবং অবশ্যই ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। রাসুল (স) এর সময় এরোপ্লেন ছিলনা – তাই এটা অনিচ্ছাকৃত বর্জন এবং এরোপ্লেনে চড়া ইবাদত নয়। তাই এটা বিদআত নয়।

তাই কোন কিছু বিদআত নাকি বিদআত নয় তা জানতে হলে আমাদের অবশ্যই নিচের কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে –

  • প্রথমেই দেখতে হবে তা ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট কিনা। হতে পারে তা কোন কথা, কাজ বা বিশ্বাস।
  • ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট হলে দেখতে হবে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা এই পদ্ধতিটি সম্পর্কে জানতেন কিনা।
  • যদি না জেনে থাকেন, তবে তাঁর উৎস ওহী নয়। আর ইসলামে সকল ইবাদতের উৎস একমাত্র ওহী।
  • যদি জেনে থাকেন, তবে তাঁরা তার উপর আমল করেছিলেন কিনা।

আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীরা যদি এমন কিছুর আমল না করে থাকেন, তবে আমাদেরও উচিত তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে এমন কিছুর উপর আমল না করা, কারণ তাঁরাই ইসলামের শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম এবং আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ।

ইসলাম একটি পূর্ণাংগ এবং ত্রুটিমুক্ত জীবনব্যবস্থা, এতে নতুন কিছু সংযোজন বা পুরনো কিছু বিয়োজনের কোন অবকাশ নেই। রাসূল (সা) বলেন –

সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মাদের আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল নতুন উদ্ভাবিত বিষয় (বিদআত) আর প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। [৩৮]

তাই কেউ যদি দাবি করেন যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এমন কোন কাজ বা পন্থা বা ইবাদত রয়েছে যা ইসলামে উল্লেখ করা নেই, তবে তিনি প্রকারান্তরে দাবী করছেন যে –

  • আল্লাহর ওহী অসম্পূর্ণ, রাসূল (সা) আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি আবিষ্কার করেছেন।
  • রাসূল (সা) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেননি, ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আরো উত্তম পন্থা তিনি আমাদের দিয়ে যাননি।

একজন মুসলিম হিসেবে আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে, উপরোক্ত দুটি চিন্তার উভয়টি বা যে কোন একটি আমাদেরকে ইসলামের বাইরে নিয়ে যায়। কারণ কুরআন ও হাদীস দিয়ে আমাদের স্পষ্টভাবে কি করতে হবে বা না করতে হবে তা বলে দেয়া আছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স) বলেন-

যা কিছু কাউকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে অথবা আগুন থেকে দূরবর্তী করে তার এমন কিছুই নেই যা কিনা তোমাদের জন্য স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়নি। [৩৯]

কুফর

কুফরীর আভিধানিক অর্থ আবৃত করা ও গোপন করা। আর শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের বিপরীত অবস্থানকে কুফরী বলা হয়। কেননা কুফরী হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান না রাখা, চাই তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হোক কিংবা না হোক। কুফর সম্পর্কে আল্লাহতা’লা বলেন-

নিশ্চয় যারা কুফরী করে, তাদের না ধন-সম্পদ এবং না তাদের সন্তানাদি আল্লাহর বিপক্ষে কোন কাজে আসবে। আর তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।[৪০]

ইসলামই যে একমাত্র জীবনব্যবস্থা তা জানাবার জন্য আল্লাহতা’লা বিদায় হজ্জ্বের মাঠে নিচের দুটি আয়াত নাযিল করেন-

আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [৪১]

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। [৪২]

আয়াত দুটি নাযিল হবার পর পৃথিবীতে কেবল দু’টি দ্বীন রয়েছে, “দ্বীন আল-ইসলাম” আর “দ্বীন আল-কুফর” – সুতরাং একজন মানুষ হয় “মুসলিম” নয় “কাফির”! ইসলাম ছাড়া আর সকল দ্বীন এবং সেগুলোর ধর্মগ্রন্থ ও নিয়মকানুন – সব বাতিল হয়ে গেছে। এই কথারই প্রতিফলন নীচের কথাগুলোতে –

It is the final religion which abrogates all religions and laws that came before it There is no religion on earth according to which Allaah is to be worshipped apart from Islam. [৪৩]

মুসলমান ও কাফিরদের মাঝে পার্থক্যের রেখা হচ্ছে ঈমান। কেউ যদি ঈমান হারায় তবে সে সব কিছুই হারালো। আল্লাহতা’লার উপর ঈমান আনা মানে হচ্ছে তাঁর আদেশ নিষেধ সবকিছু মেনে চলা। তাঁর কথা অমান্য করার অর্থই হল মুসলিমদের কাতার থেকে নাম মুছে কাফিরদের কাতারে নাম লেখানো।

শিরক

শিরক শব্দের আভিধানিক অর্থ- অংশীদারিত্ব, অংশীবাদ, মিলানো, সমকক্ষ করা, অংশীস্থির করা, সমান করা, ভাগাভাগি, সম্পৃক্ত করা। ইংরেজীতে Polytheism (একাধিক উপাস্যে বিশ্বাস), Sharer, Partner, Associate। শরীয়তের পরিভাষায়, যেসব গুনাবলী কেবল আল্লাহর জন্য নির্ধারিত সেসব গুনে অন্য কাউকে গুনান্বিত ভাবা বা এতে অন্য কারো অংশ আছে বলে মনে করাই শিরক।

শিরক হচ্ছে বান্দা আল্লাহর সাথে তাঁর রুবুবিয়্যাত সংক্রান্ত কর্ম কিংবা তাঁর জাত ও আসমা ওয়াস সিফাতে তথা নাম ও গুনাবলী অথবা উলুহিয়্যাতে (ইবাদতে) কাউকে শরীক করা। [৪৪]

অর্থাৎ আল্লাহর সাথে এমন বিষয়ে সমকক্ষ স্থির করা যেটা আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যেমন- আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো নিকট আশা করা, আল্লাহর চাইতে অন্য কাউকে বেশী ভালবাসা, অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের কোন একটি অন্যের জন্য করাকে শিরক বলে। শিরকের ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, এতে দু‘শরীকের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়। বরং সহস্রভাগের একভাগের অংশীদার হলেও তাকে অংশীদার বলা হয়। তাই আল্লাহতা‘লার হকের সামান্যতম অংশ অন্যকে দিলেই তা শিরকে পরিণত হবে, এতে আল্লাহর অংশটা যতই বড় রাখা হোক না কেন।

শিরক অবশ্যই পরিত্যাজ্য। এ ব্যপারে আল্লাহতা’লা বলেন –

তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।[৪৫]

হে বনী ইসরাইল! তোমরা আমার রব এবং তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর। কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। [৪৬]

আহলে কিতাব ও মুশরিক কাফেররা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। [৪৭]

যদি তোমরা তাদের (মুশরিকদের) কথামত চল তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে। [৪৮]

উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহতা’লা মুসলিমদেরকে শিরক থেকে সাবধান করে দিয়েছেন যে, যদি তারা মুশরিকদের আক্বীদা-বিশ্বাস, কাজ-কর্মে আনুগত্য করে তাহলে তারা মুশরিক হয়ে যাবে। শিরক মূলত এ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকেই অস্বীকার করে। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্য, এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন –

আমি মানব এবং জ্বিন জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।[৪৯]

শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর মর্যাদা এবং নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করা হয়। আল্লাহ হচ্ছেন আমাদের রব এবং ইলাহ, আর আমরা হচ্ছি তার বান্দা বা দাস। যা কিছু আছে সবই আল্লাহর সৃষ্টি। প্রধান কয়েক ধরণের শিরকগুলো একটু আমরা দেখে নেই[৫০] –

রবুবিয়াতের ক্ষেত্রে শিরক – এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ’র পাশাপাশি অন্য রব বা সৃষ্টিকর্তা আছে।

ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক – এটা হল আল্লাহ্’র সাথে অন্যের ইবাদত করা, যেমন নবীদের এবং নেককার বান্দাদের। যেমন অনেকেই বিপদে পড়ে নেককার বান্দাদের কাছে সাহায্য চায়, বেশিরভাগ সময়ই লোকজন মাজারে গিয়ে মৃত পীর-আউলিয়াদের কাছে সাহায্য চায়। এ জাতীয় কাজ শিরক।

আল্লাহতা’লার গুণের মধ্যে শিরক – আল্লাহর কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট গুণে ভূষিত করা হলেও শিরক হবে। যেমন গায়েব (ভবিষ্যৎ) এর ইলম জানা। অর্থাৎ কেউ যদি দাবী করেন যে সে ভবিষ্যৎ জানে বা ভবিষ্যতে কি হবে তা দেখতে পায় তবে তা শিরকের পর্যায়ে পড়বে।

বিদাত ও কুফর

আমরা আগেই দেখেছি যে, বিদআত আমাদের ভাবতে শেখায়-

  • আল্লাহর ওহী অসম্পূর্ণ, রাসূল (সা) আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি আবিষ্কার করেছেন।
  • রাসূল (সা) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেননি, ফলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আরো পন্থা তিনি আমাদের দিয়ে যাননি।

অন্যকথায় আমরা আসলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বাণী ও কাজে সন্দেহ প্রকাশ করছি যে তাঁরা যা বলেছেন তার চেয়েও উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে। এই ভাবনাটা কিন্তু আমাদের ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মত একটা পদক্ষেপ। চিন্তা করুন – আপনার প্রতিপালক তাঁর রাসুলের মাধ্যমে আপনাকে ইবাদতের ব্যপারে যা শিখিয়েছেন, আপনি বিশ্বাস করছেন যে তার চেয়েও ভাল কোন নিয়ম আপনার কাছে রয়েছে। অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসুল (স) এর শেখানো পদ্ধতি আপনার কাছে অপ্রতুল মনে হচ্ছে। অর্থাৎ সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ মানব রাসুল (স) নিজে যেভাবে ইবাদত করেছেন সেটা আপনার কাছে পর্যাপ্ত মনে হচ্ছেনা – কী ভয়ানক কথা! আর এই বিশ্বাসই আপানকে কুফরে নিমজ্জিত করে ফেলবে।

বিদাত ও শিরক

মূর্তিপূজা যে শিরকের সবচেয়ে প্রকাশ্য এবং জঘন্য রূপ এ ব্যাপারটি সর্বজনস্বীকৃত। আল্লাহ পাক আল কুর’আনে হয়রত নূহ (আ) এর জাতির বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন-

এবং বলেছিল, ‘তোমরা কখনও পরিত্যাগ করো না তোমাদের দেব-দেবীকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া’আ, ইয়াগূস, ইয়া’ঊক ও নাসর-কে’। [৫১]

এতে হয়রত নূহ (আ) এর জাতির যে উপাস্যগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা ছিল তাদের পূর্ববর্তী যুগের সৎকর্মশীলদের নাম। কিন্তু তাদের পূজা কিভাবে শুরু হল সেটা আমরা জানতে পারি নিচের হাদীস থেকে –

হযরত মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস (রহ.) বলেন যে, ঐ লোকগুলো ছিলেন আল্লাহর ইবাদাতকারী, দ্বীনদার,আল্লাহ ওয়ালা ও সৎ। তাঁরা হযরত আদম (আঃ) ও নূহ (আ) এর ছিলেন সত্য অনুসারী,যাদের অনুসরণ অন্য লোকেরাও করতো। যখন তারা মারা গেলেন। তখন তাদের অনুসারীরা পরস্পর বলাবলি করলোঃ ‘যদি আমরা এদের প্রতিমূর্তি তৈরী করে নেই, তবে ইবাদাতে আমাদের ভালভাবে মন বসবে এবং এদের প্রতিমূর্তি দেখে আমাদের ইবাদাতে আগ্রহ বাড়বে।’ সুতরাং তারা তাই করল। অতঃপর যখন এই লোকগুলোও মারা গেল এবং তাদের বংশধরদের আগমণ ঘটল, তখন শয়তান তাদের কাছে এসে বললোঃ ’তোমাদের পূর্বপুরুষরাতো ঐ বুযুর্গ ব্যক্তিদের পূজা করত এবং তাদের কাছে বৃষ্টি ইত্যাদির জন্য প্রার্থনা করত। সুতরাং তোমরাও তাই করো।’ তারা তখন নিয়মিতভাবে ঐ মহান ব্যক্তিদের পূজা শুরু করে দিল।[৫২]

উপরের কথাগুলো থেকে কয়েকটি বিষয় একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে-

  • প্রথমে নূহের জাতির জন্য স্মারক বানানোর পুরো ব্যাপারটির উদ্দেশ্যই ছিল সৎ-আল্লাহর ইবাদাতে মনোযোগ বৃদ্ধি। কিন্তু এই পদ্ধতিটি ঐশী বাণী দ্বারা সমর্থিত ছিলনা। ইসলামী পরিভাষায় একে আমরা স্বচ্ছন্দে বিদ’আত হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
  • বিদআত রাতারাতি শিরকে পরিণত হয়না (সাধারণত), কয়েক প্রজন্ম সময় লাগে।
  • শয়তান আপাতদৃষ্টিতে ভাল পরামর্শই দিয়ে থাকে। ঐশী জ্ঞানের সাহায্য ছাড়া তার কুটকৌশল বোঝা কঠিন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বিদআত আসলে কুফর ও শিরকের পথে আমাদের চালিত করে। যার ফলে বিদআত সম্পর্কে আমাদের শুরু থেকেই সতর্ক হতে হবে – না হলে এই বিদআতই আমাদেরকে কুফর ও শিরকের মাঝে নিয়ে ফেলে দিবে।

কোয়ান্টাম মেথড – শূন্য কথা

কোয়ান্টাম মেথড বলতে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন কি বোঝাচ্ছে সেটা আমাদের জানা দরকার। এই লেখাটিরই “বিজ্ঞান” পর্বে আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নিয়ে হালকাপাতলা পরিচিতিপর্ব সেরে ফেলেছিলাম। এই পর্বে আমরা আরো বিশদভাবে পরিচিত হব এই ফাউন্ডেশনের সাথে – একেবারে শূন্য লেভেল থেকে।

মেডিটেশন বা ধ্যানচর্চা

সবার মাঝে ধ্যানচর্চা ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে নব্বইয়ের দশকে যোগ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়। কালপরিক্রমায় সেটাই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নাম নিয়ে বর্তমানে পথ চলছে। দেশে বিদেশে প্রচুর শাখা খুলে বসেছে এই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মূলমন্ত্রই হল ধ্যান বা মেডিটেশন করা, ধ্যান বা মেডিটেশন করে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। আর সেই ক্ষমতাবলে আপনি দূর করবেন আপনার সকল সীমাবদ্ধতা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলে-

মানুষের অসীম শক্তি ও সম্ভাবনাকে সবসময় শৃঙ্খলিত ও পঙ্গু করে রাখে সংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। … এই ভ্রান্ত ধারণার শিকল ভেঙে মুক্ত বিশ্বাসে উপনীত হওয়াটাই হচ্ছে মানুষের আসল স্বাধীনতা। কারণ মুক্ত বিশ্বাস হচ্ছে সকল সাফল্য, সকল অর্জনের ভিত্তি। বিশ্বাসই রোগ নিরাময় করে, ব্যর্থতাকে সাফল্যে আর অশান্তিকে প্রশান্তিতে রূপান্তরিত করে। বিশ্বাসই মেধাকে বিকশিত করে, যোগ্যতাকে কাজে লাগায়, দক্ষতা সৃষ্টি করে। বিশ্বাসই অভাব দূর করে, প্রাচুর্য সৃষ্টি করে। …ভ্রান্ত ধারণা ও সংস্কারের শৃঙ্খল মুক্তির পথ হচ্ছে মেডিটেশন। … তখন প্রতিবারের প্রার্থনাতেই আপনি পুলকিত হবেন, প্রতিটি সেজদাই পরিণত হবে মেরাজে। … মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে। … মেডিটেশনের পথ ধরেই আপনি লাভ করবেন পারিপার্শ্বিক দুষ্টচক্রের শৃঙ্খল ভাঙার অন্তর্গত শক্তি। … আপনি অতিক্রম করবেন আপনার জৈবিক অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা। [৫৩]

মেডিটেশনের কথা বলতে গিয়ে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলছে যে হযরত ইউসুফ (আ) ধ্যান করতেন এবং ধ্যান করেই তিনি সকল সাফল্য লাভ করেন –

বরং কারাগারে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করার সাধনায় নিজেকে নিয়োগ করেন। বন্দী জীবনকে তিনি ধ্যানের মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বিকশিত করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন।[৫৪]

এই ধ্যানচর্চা জিনিসটা কি সেটা বোঝানোর জন্য একটা ব্রেন ওয়েভ প্যাটার্ণ সারণী দেয়া হয়েছে[৫৫], যেখানে থিটা লেভেল সম্পর্কে বলা হয়েছে মেডিটেশনকালে সাধকরা এই স্তরে প্রবেশ করেই মহাচৈতন্যের (super consciousness) সাথে সংযোগ স্থাপন করতেন। এর পরবর্তী লেভেল ডেল্টাতে বলা হয়েছে যে দরবেশ ঋষিরা এই স্তরেও সজাগ থাকেন আবার মহাচৈতন্যে লীনও হতে পারেন। তবে এই মহাচৈতন্যে জিনিসটির সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোন ধরণের সংজ্ঞাই বইটির কোথাও দেয়া নেই।

মেডিটেশনের প্রথম ধাপ হচ্ছে ‘শিথিলায়ন’ যার মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। শিথিলায়নের মধ্য দিয়েই ধ্যানাবস্থায় যেতে হয়। ধ্যানাবস্থায় মানুষজন যা খুশি তাই ঘটিয়ে ফেলার এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা ঈশ্বরসমান ক্ষমতা লাভ করে। এই ক্ষমতা সম্পর্কে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলে –

শিথিলায়ন পুরোপুরি আয়ত্ত হলেই আপনি মনের শক্তিবলয় নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হাতে পাবেন। ধ্যানাবস্থায় মন হয় ত্রিকালদর্শী, চেতনা অতিক্রম করে সকল বস্তুগত সীমা। মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক দরবেশ ঋষিরা একদিন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছা করেছেন – ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন – মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। আপনিও এ চাবিকাঠিকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করতে পারেন অতিচেতনা। এই চাবিকাঠি দিয়েই দৃশ্যমান সব কিছুর পেছনে যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম কাজ করছে তার সবটাকেই আপনি নিজের ও মানবতার কল্যাণে সক্রিয় করে তুলতে পারবেন।[৫৬]

তো মোটামুটি এই হচ্ছে মেডিটেশন – যার মাধ্যমে একজন মানুষ অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সাধু-ঋষিদির মত প্রকৃতির নেপথ্য স্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ও অপরের ভাগ্য গড়ে নেয়।

মনছবি

শিথিলায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের মাঝে এমন এক ক্ষমতা তৈরি হয় যার ফলে সে তার কল্পনা শক্তি দ্বারাই নিজের চাওয়া পাওয়া পূরণ করে ফেলতে পারে, নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটিই হচ্ছে মনছবি। মনছবি ব্যবহার করে ঘটিয়ে ফেলা কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মধ্যমেই জানতে পারা যায় –

এক তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে ভাবছে কি করবে। সে মনছবি দেখল একটি চাকরির। এমন চাকরি যেখানে কাজ কম কিন্তু বেতন বেশি। সে নিয়মিত মনছবি দেখতে লাগল আর এ ধরনের কাজ যে সব প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যেতে পারে সেখানে ডাকযোগে বায়োডাটা পাঠিয়ে দিল। দেড় মাসের মধ্যে একটি বিদেশী দূতাবাসে চাকরি হয়ে গেল তার।[৫৭]

এক ইঞ্জিনিয়ার। সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার মনছবি দেখতে লাগল। ডিভি ভিসা পেয়ে গেল। ভিসা পাওয়ার পর মনছবি দেখতে লাগল সমমানের চাকরির, যাতে নিজের প্রকৌশল জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারেন। দেশে তিনি কাজ করতেন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দেড় মাসের মধ্যে একই প্রতিষ্ঠানে আগের চেয়েও দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি হয়ে গেল তার।[৫৭]

অর্থাৎ কেবলমাত্র মনে মনে কল্পনা করেই যেকোন জিনিস ঘটিয়ে ফেলা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা আছে নেলসন ম্যান্ডেলা, মাওসেতুং, মালয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, উড়োজাহাজের আবিষ্কর্তা রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা দিলীপকুমার, মুষ্টিযোদ্ধা জর্জ ফোরম্যান কিংবা ফিলিস্তীনের হাজার হাজার জনতা – যারা (কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভাষ্যমতে) মনছবি দেখে দেখে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে।[৫৮] অবশ্য যারা এটাকে ফ্যান্টাসি মনে করছেন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মতে তারা মূর্খ[৫৯]।

স্বপ্ন চর্চা ও আইচিং এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎগণনা

কোয়ান্টাম মেথডের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ হচ্ছে স্বপ্নচর্চা বা স্বপ্নব্যাখ্যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গণনা বা ভবিষ্যৎ দর্শন করা। স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দেখে নেয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার, কারণ মহামতি বুদ্ধের মা মায়াদেবী, শ্রী রাম কৃষ্ণ পরম হংসদেবের পিতা ক্ষুদিরাম, জুলিয়াস সিজার, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ইংরেজ কবি শেলী, কবি টেনিসন প্রমুখ স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন। তাছাড়া বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভন কাকুল, সেলাই মেশিন আবিষ্কারক ইলিয়াস হাওয়ে, বল বিয়ারিং-এর আবিষ্কর্তা জেমস ওয়াট সহ অনেক বিজ্ঞানীরা তাদের সমস্যার সমাধান স্বপ্নেই পেয়ে গেছেন।[৬০] এ ছাড়াও স্বপ্ন চর্চার ও ব্যাখ্যার অনুশীলন বলতে গিয়ে হয়রত ইউসুফ (আ) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে এও বলা হয়েছে যে হিন্দুদের স্বপ্ন চর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল অথর্ববেদ বা বৌদ্ধভিক্ষুদের স্বপ্নচর্চাকারী সম্প্রদায় স্বপ্নযোগীর মত ইসলাম ধর্মেও আলেমদের অনেকে যে ‘ইস্তেখারা’ করে ভালমন্দ বলেন, তা-ও স্বপ্নচর্চা ও স্বপ্নের সৃজনশীল প্রয়োগেরই একটি বিশেষ মাত্রা।[৬০] অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মতে স্বপ্নচর্চার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানার প্রয়াস থেকেই বিভিন্ন আলেমগণ ইসলাম ধর্মে স্বপ্নচর্চা করে থাকেন এবং স্বপ্নচর্চার জন্য তারা ‘ইস্তেখারা’ সালাত আদায় করেন! শুধু স্বপ্নচর্চা নয় বরং “আইচিং” এর মাধ্যমেও ভবিষ্যৎ গণনার উপর শিক্ষা দেয়া হয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে।[৬১] আইচিং হচ্ছে ভবিষ্যৎগণনার জন্য চীনদেশীয় একটা পদ্ধতি, যাতে মাটিতে কাঠি বা পয়সা ফেলে ভাগ্যগণনা করা হয়।[৬২]

কোয়ান্টাম নিরাময়

রোগের মূল কারণকে মানসিক আখ্যায়িত করে এখানে মেডিটেশনের মাধ্যমে সকল রোগ ব্যাধি উপশমের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে[৬৩]। মনছবি বা ইমেজ থেরাপি ছাড়াও রয়েছে ‘দেহের ভিতরে ভ্রমণ’ নামক পদ্ধতি যেখানে রোগীকে প্রথমে শিথিলায়ন করতে বলা হয়, তারপর শরীরের নানা অঙ্গের মধ্য দিয়ে কাল্পনিক ভ্রমণ করতে বলা হয়। এতে সে তার সমস্যার স্বরূপ সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি লাভ করে এবং নিজেই কমান্ড সেন্টারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। যেমন-

একজন ক্যান্সারের রোগী তার ক্যান্সারের কোষগুলোকে কল্পনা করে সর্ষের দানারূপে।আর দেখে অসংখ্য ছোট ছোট পাখি ওই সর্ষে দানাগুলো খাচ্ছে। আর সর্ষের দানার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। আস্তে আস্তে সর্ষের দানা নিঃশেষ হয়ে আসছে। সর্ষের দানাও শেষ, নিরাময়ও সম্পন্ন। [৬৪]

শিথিলায়ন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে –

শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্যথা উপশম করার জন্য আপনাকে সাধু সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হবার প্রয়োজন নেই। এজন্য নির্বাণ বা ফানাফিল্লাহর স্তরেও আপনাকে যেতে হবেনা।[৬৫]

এখানে যে নির্বাণ[৬৬] ও ফানাফিল্লাহ[৬৭] এর কথা বলা হচ্ছে তা হল যথাক্রমে বৌদ্ধধর্ম ও সুফিবাদ থেকে আগত ধ্যানের দুটি অবস্থা।

মাটির ব্যাংক

মাটির ব্যাংক হচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে মানত করে টাকা জমা করার একটি মাধ্যম। পরে জমাকৃত টাকাসহ মাটির ব্যাংকটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অফিসে জমা দিতে হয়। এটি শুধু টাকা জমা রাখার পাত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়না বরং এটা দাতার জন্য কল্যানকর অনেক কিছু বয়েও আনে। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বক্তব্য হচ্ছে-
দাতা এর মাধ্যমে শুধু পারলৌকিক পুণ্য অর্জনের সুযোগই পান না, দৈনন্দিন জীবনেও পাচ্ছেন প্রাচুর্য, দুরারোগ্য ব্যধি থেকে মুক্তি এবং বালা-মুসিবত মুক্তি।[৬৮]

কল্যাণকর এরকম কিছু কাহিনী নিচে উল্লেখ করা হল-

ম্যানেজারের অসততার কারণে দুবাইতে আমার প্রথম চাকরিটি হারাতে হয়। কিন্তু হতাশ না হয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি ও ইন্টারভিউ দিতে থাকলাম। এর সাথে মাটির ব্যাংকে ১০০০ টাকা পাঠালাম ও মনছবি দেখতে লাগলাম সর্বনিম্ন ৩০০০ থেকে ৩৫০০ দিরহাম (৬০-৭০ হাজার টাকা) এর মধ্যে একটি চাকরি পাচ্ছি। এর মধ্যে ৫০ হাজার টাকার অর্থাৎ ২৫০০ দিরহামের কয়েকটি অফার এলো। আমি অফারগুলো ফিরিয়ে দিয়ে নিয়মিত মেডিটেশন ও মনছবি দেখতে লাগলাম। অবশেষে একটি গ্রুপ অফ কোম্পানিতে একাউনটেন্ট জেনারেল হিসেবে ৩০০০ দিরহাম বেতনে ১ মাসের মধ্যে চাকরি হয়ে গেল।[৬৯]

হোঁচট খেয়ে আমার ডান পায়ের হাঁটু ফুলে গেল। ব্যথার জায়গায় রক্ত জমে কালচে রং ধারণ করেছে। ঘুমানোর আগে ব্যথানাশক ওষুধ খেলাম। মাঝরাতে প্রচন্ড ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল। সবাই তখন ঘুমিয়ে আর আমি বিছানায় বসে হাঁটু ধরে কাঁদছি। ব্যথা উপশমের উপায় খুঁজতে খুঁজতে মাটির ব্যাংকের কথা মনে হলো। নিয়ত করে টাকা ফেলবো বলে বিছানা থেকে নামছি, অনুভব করলাম পুরো ডান পায়ে ব্যথা ছড়িয়ে গেছে, পা ফেলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে ভয়ে ভয়ে একটু হাঁটলাম। অথচ পায়ে আর কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করলাম না। এমনকি রক্ত জমাটের স্থানেও কালচে দাগ নেই। সেই থেকে আমি সবাইকে মাটির ব্যাংকে দানের কথা বলি।[৭০]

সদ্য কেনা জমির নামজারি ও মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে আলোচনা করতে সেখানকার ভূমি অফিসে যেতে হলো। মেইন রোড থেকে ১০ মিনিটের পথ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরে ছিলো সে অফিস। কাঁচা রাস্তা বলে হেঁটে রওনা দিলাম। অফিসে পৌঁছে খেয়াল হলো হাতে ফাইল নেই, ওটার ভেতরেই দলিল ছিলো। দলিল না পেলে জমি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া এর কোনো ফটোকপিও আমার কাছে নেই। সাথে সাথে খুঁজতে বেরুলাম। রাস্তার আশপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজছি, সামনে যাকে পাচ্ছি তাকেই জিজ্ঞেস করছি। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। দলিলের আশা ছেড়ে দেবো কি না ভাবতে ভাবতেই মাটির ব্যাংকে দান করার নিয়ত করলাম। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই এক কিশোর আমাদেরকে বলাবলি করতে দেখে স্থানীয় এক স্কুলঘরে নিয়ে গেল। সেখানে দেখলাম দলিলটি টেবিলে রাখা, কেউ একজন তা কুড়িয়ে পেয়ে দিয়ে গিয়েছিলো।[৭১]

২০০৮ সালের রমজান মাস। ওযু করার পর মনে হলো কানের হিয়ারিং এইড তো খুলি নি। এই যন্ত্রের প্রধান শত্রু হলো পানি। যে কারণে এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। কেননা জন্ম থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ায় শোনার জন্যে এ যন্ত্রের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। মন খারাপ নিয়ে ইফতার করলাম। মাগরিবের নামাজ শেষে মাটির ব্যাংকে টাকা ফেলার নিয়ত করলাম এবং প্রার্থনা করলাম যাতে হিয়ারিং এইডটি ঠিক হয়ে যায়। এর ঠিক আধঘণ্টা পর খেয়াল করলাম শুনতে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সব শব্দই আমি স্বাভাবিকভাবে শুনতে পাচ্ছি।[৭২]

এরকম আরো বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সাইটে [৭৩]। উপরের এসব উদাহরণ থেকে আমরা মাটির ব্যাংকের কার্যকারিতা সম্পর্কে এই ধারণা পাচ্ছি যে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই আপনার মনোবাসনা পূরণ বা কল্যান সাধন কিংবা কল্যান ত্বরান্বিত করতে পারবেন।

কোয়ান্টা সংকেত

কোয়ান্টা সংকেতকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায় – কোয়ান্টা ধ্বনি আর কোয়ান্টা ভঙ্গি।[৭৪] কোয়ান্টা সংকেত সম্পর্কে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বক্তব্য হচ্ছে –

কথিত আছে অলৌকিক শক্তি বলে দরবেশ ও ঋষিরা সব অসাধ্য সাধন করতেন। ইসম বা মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর জাদুর মত সব ঘটনা ঘটে যেত। … দরবেশদের এই ইসমগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আল্লাহ’, ‘ইয়া হু’, ‘ইয়া হক’ সহ নানা জিকির। ঋষিদের মন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ওম’ সহ নানা জপ মন্ত্র। খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের রয়েছে ‘আমেন’। জাপানী বুদ্ধদের ‘নামো আমিদা বাৎসু’ প্রভৃতি মন্ত্র। পাশ্চাত্যে ধর্মহীন ধ্যানীরা অবশ্য পুরোপুরি ধর্ম নিরপেক্ষ ধ্বনি যেমন ‘শান্তি’, ‘প্রেম’, ‘ওয়ান’, ‘পেন’ বা কোন অর্থহীন ধ্বনিকেও মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। দরবেশ-ঋষিরা সাধনায় যেমন লক্ষ লক্ষ বার তাদের মন্ত্র জপ করতেন, তেমনি এই বিশেষ ধর্ম বহির্ভূত ধ্যনীরা নিজেদের পছন্দমত কোন শব্দ লক্ষ লক্ষ বার উচ্চারণ করেন। তাদের বিশ্বাস এইভাবে অগণিত বার উচ্চারণের ফলে এই ধ্বনি এমন একটা মনোদৈহিক স্পন্দন সৃষ্টিতে সহায়ক হয় যা একজন মানুষকে মুহূর্তে তার মনোদৈহিক সামর্থ্য ও শক্তি পুরোপুরি একাগ্রভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম করে। মন ও দেহ চলে যায় শক্তির স্তরে। ব্যক্তিমন ও চেতনা সংযুক্ত হয় মহাচেতনা বা কসমিক কনশাসনেসের সাথে। তখন অর্জিত হয় দৃশ্যমান সবকিছুর পেছনে প্রকৃতির যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম ক্রিয়াশীল তাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা।[৭৪]

অর্থাৎ এর মাধ্যমে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জিত হয়। কোয়ান্টা ধ্বনি আর কোয়ান্টা ভঙ্গির উপকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে –

কোয়ান্টা ধ্বনি উচ্চারণ এবং কোয়ান্টা ভঙ্গি করা মাত্রই মেডিটেশন লেভেলে পৌঁছে যেতে এবং পরিকল্পিত কাজকে সহজতর করতে পারেন। [৭৫]

কোয়ান্টা ভঙ্গি সম্পর্কে বলা হয়েছে –

দরবেশ ও ঋষিরা যেমন মন্ত্র বা ইসম এবং অভয় মুদ্রা বা জ্ঞান মুদ্রাকে ব্যবহার করেছেন, আপনিও ব্যবহার করতে পারেন কোয়ান্টা ধ্বনি এবং কোয়ান্টা ভঙ্গি। আপনি মহামতি বুদ্ধ সহ প্রাচীন ঋষিদের যে ভাস্কর্য দেখতে পান, তার বেশির ভাগই অভয় মুদ্রা বা জ্ঞান মুদ্রা করে পদ্মাসন বা সিদ্ধাসনে বসা।[৭৬]

অর্থাৎ আমরা হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সিদ্ধপুরুষ ও দেবতাদের উপাসনারত যে ছবিগুলো দেখি বা গৌতম বুদ্ধের ধ্যানরত যে ছবিগুলো দেখি – সেসব ছবিতে তারা ধ্যান বা তপস্যা করার জন্য যেভাবে বসে থাকেন সেটাকেই কোয়ান্টাভঙ্গি বলা হচ্ছে। এই কোয়ান্টাভঙ্গির কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও অবশ্য এর জ্যোতিষশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকেই –

সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড (পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ - জানুয়ারী, ২০০০) এর ১৬৩ নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন করতে পারেন কোয়ান্টা ভঙ্গি বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীর সমন্বয়ে শুধুমাত্র ২ আঙুলে করতে হবে কেন, এটা তো ৩ আঙুল মিশিয়ে করা যেতে পারে। প্রাচীন ঋষি দরবেশরা কেন ২ আঙুলে করেছেন। এর পুরোপুরি ব্যাখ্যা প্রায় বিস্মৃতির অতলে অপসৃত। কিন্তু এর জ্যোতিষ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমাদের জানা। আমরা জানি, হাতের বুড়ো আঙুলের ক্ষেত্র হচ্ছে শুক্র বা ভেনাসের ক্ষেত্র। তর্জনীর ক্ষেত্র হচ্ছে বৃহস্পতির ক্ষেত্র। জ্যোতিষ বিজ্ঞানে শুক্র ও বৃহস্পতি এ দুটো গ্রহই প্রবৃদ্ধি, কল্যাণ ও সাফল্যের প্রতীকরূপে গণ্য। আর মধ্যমার ক্ষেত্র শনির ক্ষেত্র রূপে বিবেচিত। আর শনি বিলম্ব ও বাধার প্রতীক। প্রাচীন সাধকরা এ কারণেই ভেনাস ও জুপিটারের প্রবৃদ্ধিকেই সংযুক্ত করেছেন। এর সাথে শনির প্রভাবকে যুক্ত করতে চান নি। অতীতের সাধকরা কোয়ান্টা ভঙ্গি ২ আঙুলেই করেছেন। আর অধুনা সফল ব্যক্তিরাও সঙ্কট উত্তরণে এভাবেই কোয়ান্টা ভঙ্গি করছেন। [৭৪]

অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন জ্যোতিষশাস্ত্রে ব্যবহৃত এই ভঙ্গিটির একটা ইসলামী ব্যাখ্যা দিয়েছে –

কোয়ান্টা ভঙ্গি বা সংকেতের আর একটি মজার দিক আছে। আপনি ডান হাতে কোয়ান্টা ভঙ্গি করে হাত সামনে আনুন। ভাল করে দেখুন হাতে কিছু দেখছেন কি না। খেয়াল করলে দেখবেন হাতে আরবী ‘আলিফ’ ‘লাম’ ও ‘হে‘ অর্থাৎ আল্লাহু হয়ে আছে। অর্থাৎ কোয়ান্টা ভঙ্গি করার সাথে সাথে আপনি প্রকারান্তরে স্রষ্টাকে স্মরণ করছেন।[৭৪]

সাফল্যের চাবিকাঠি কোয়ান্টাম মেথড (পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণ - জানুয়ারী, ২০০০) এর ১৬৫ নাম্বার পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে।

তবে ইসলামের দৃষ্টিতে এই ব্যাখ্যাটি কোত্থেকে এসেছে কিংবা কুরআন-হাদীসের সাপেক্ষে তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সেসব ব্যাপারে অবশ্য কোন রেফারেন্স দেয়া হয়নি।

কমান্ড সেন্টার

কমান্ডসেন্টার হচ্ছে শক্তি কেন্দ্র। ধ্যান করে আপনার মধ্যে অতিচেতনার উন্মেষ ঘটলে সেটাকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য কাজ করার জন্যই কমান্ড সেন্টার বানাতে হয়। কমান্ডসেন্টার থেকে আপনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কমান্ড সেন্টার সম্পর্কে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বক্তব্য হচ্ছে –

কমান্ড সেন্টারকে এক কথায় বলা যায়, মনের বাড়ির শক্তি ও কল্যাণ কেন্দ্র। মানব অস্তিত্বের যে অংশ স্থান-কালে (Time and space) আবদ্ধ নয়, সে অংশ এই কমান্ড লেভেলে প্রকৃতির নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়মের সাথে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করে। আর আপনি জানেন, দৃশ্যমান সবকিছুর পেছনেই সক্রিয় রয়েছে প্রকৃতির এই নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম। স্থান-কালের সীমানা অতিক্রম করে যোগাযোগ, তথ্যানুসন্ধান এবং নিজের ও মানবতার কল্যাণের সকল প্রক্রিয়া সম্পাদনের প্রয়োজনীয় সব উপাদানই রয়েছে এখানে। আর সবকিছুই থাকে সদা প্রস্ত্তত অবস্থায়। [৭৭]

কমান্ডসেন্টার কি রকম হবে সে ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বর্ণনা হচ্ছে –

এটি একটি বিশাল হল কক্ষ। এখানে আপনার জন্যে একটি বিশেষ কমান্ড চেয়ার, অন্তর্গুরুর জন্যে বিশেষ চেয়ার, তিনটি মনিটরিং স্ক্রিন, ডান দিকের কোনায় ‘রহম বলয়’ বা আশীর্বাদ বলয় বা ‘প্লেস অব ব্লিস’, ডানে একটা সোনার বাথ টাব, একটি টাইম মেশিন, যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ, মনিটরিং নিরাময় ও সার্বিক কল্যাণ সাধনের প্রয়োজনীয় সব কিছুই আপনি প্রথমবার ঠিকঠাক করে নেবেন। [৭৭]

কমান্ডসেন্টারে গিয়ে স্থান-কালের উর্ধ্বে চলে গিয়ে যেকোন তথ্যানুসন্ধান কিংবা নিজের ও অন্যের কল্যাণ করা সম্ভব হয়। যেহেতু আপনি কালের অর্থাৎ সময়ের উর্ধ্বে তাই এখান থেকে সহজেই অতীত বা ভবিষ্যৎ দেখা সম্ভব হয়। অতীত-ভবিষ্যৎ দেখার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কমান্ডসেন্টারেই স্থাপন করতে হয় –

চেয়ারের হাতলে বা চেয়ারের সামনে সব রিমোট কন্ট্রোল সুইচ। চেয়ারের সামনে ৩টি মনিটরিং স্ক্রিন। বামেরটি অতীতের সবকিছু দেখার জন্য। মাঝেরটি বর্তমান আর ডানেরি ভবিষ্যৎ দেখার জন্য। [৭৮]

কমান্ডসেন্টারের বিভিন্নরকম প্রয়োগ আছে। এখানে বসে আপনি অন্যের অসুখ সারিয়ে তুলতে পারবেন কিংবা ভবিষ্যৎ জেনে সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এ নিয়ে অনেকগুলো উদাহরণ থেকে দুটি নিচে দেয়া হল-

ব্যবসায়িক টেন্ডার দাখিলের জন্যেও কমান্ড সেন্টার ব্যবহার করা যায়। আপনি টেন্ডারের সর্বনিম্ন দর কি হবে এটা জানার জন্যে মাঝের মনিটর (২ নম্বর মনিটর) বা টিভির ওপর বাম দিকে একটি লাল বাতি এবং ডান দিকে একটি সবুজ বাতি স্থাপন করুন। ধরুন আপনি একটি জিনিসের দর দিতে চাচ্ছেন ৪৮০ টাকা। ৪৮০ টাকার কথা চিন্তা করে মনিটরের দিকে তাকান। লাল বাতি জ্বলে উঠলে বুঝবেন এই দর সর্বনিম্ন নয়। তাহলে আস্তে আস্তে দর নিচের দিকে নামাতে থাকুন। ৪৭০ টাকা- আবার লাল বাতি জ্বলে উঠল। বোঝা গেল এতেও চলবে না। নামাতে নামাতে ৪৪৫ টাকায় যখন এলেন সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। অর্থাৎ ৪৪৫ টাকা সর্বনিম্ন দর হবে। একজন কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার পর ঠিকাদারি ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেন। একটা বড় অঙ্কের টেন্ডার দাখিল করবেন। ইঞ্জিনিয়াররা বলল একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক। এতে কাজ পাওয়া যাবে কিন্তু কোন লাভ হবে না। তিনি মেডিটেশন করলেন এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা পর মেডিটেশন থেকে উঠে বললেন দরপত্রের অঙ্ক আরও এক কোটি বাড়াতে। ইঞ্জিনিয়াররা হা হা করে উঠল, তাহলে আমরা টেন্ডার পাব না। তিনি বললেন, আমরাই পাব। ইঞ্জিনিয়াররা দরপত্র পুনর্বিন্যাস করল সেভাবে। তিনিই সর্বনিম্ন হয়ে টেন্ডার পেলেন। এক কোটি টাকাই লাভ।[৭৯]

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা একটি পশ্চিমা দেশের ভিসা নিতে যাবেন। রাতে কমান্ড সেন্টারে দেখলেন, লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কাউন্টারে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। তাকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই ভিসা দিয়ে দিচ্ছে। পরদিন সকালে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কাউন্টারে দেখেন অন্য পুরুষ, অন্য মহিলা কাজ করছেন। তিনি একটু বিব্রতবোধ করলেন। লাইন এগুচ্ছে। শিক্ষিকার সামনে এখন মাত্র একজন। এ সময় পালা বদল হলো। যারা কাজ করছিলেন তাদের বদলে অন্য ২ জন এসে কাউন্টারে বসলেন। শিক্ষিকা বিস্মিত হয়ে দেখলেন কমান্ড সেন্টারে যাদের দেখেছিলেন, এরা তারাই। শিক্ষিকা কাউন্টারে পৌঁছার পর এরা শুধু পাসপোর্ট দেখলেন, মৃদু হাসলেন। পাসপোর্ট রেখে বললেন, বিকেলে ভিসা নিয়ে যাবেন।[৮০]

কমান্ডসেন্টারে বসে কোয়ান্টামের সদস্যরা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান। যার ফলে মাদকাসক্তি দূরীকরণ, ইন্টারভিউ বা প্রমোশন সহজ করা, ভাইভা বোর্ডের মুখোমুখি সফল করা, দেনাদার থেকে টাকা আদায়, পারিবারিক মত বিরোধ দূর, সফল অস্ত্রোপচার, যন্ত্রের যান্ত্রিক ত্রুটি বা তথ্য বের করার জন্যে কিংবা ঘরে বসে বহুদূরে কারো উপর নজরদারী – প্রভৃতি কাজ করে ফেলা সম্ভব! কমান্ডসেন্টারে বসে তারা যা কখনো দেখেননি তা সম্পর্কেও নির্ভুল তথ্য দিতে পারেন-

যাকে তাঁরা জীবনে দেখেন নি, যার কথা তাঁরা জীবনে শোনেন নি, শুধু তার নাম, বয়স ও ঠিকানা বলার সাথে সাথে তার এমন হুবহু বর্ণনা দিতে থাকেন যে, প্রশ্নকর্তা নিজেই হতবাক হয়ে যান।[৮১]

অন্তর্গুরু

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মতে –

আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে হলে একজন আলোকিত গুরু, মুর্শিদ বা গাইডের কাছে বায়াত বা দীক্ষা গ্রহণ প্রয়োজন। বায়াত বা দীক্ষা গ্রহণ ছাড়া নিজে নিজে আধ্যাত্মিক সাধনা এক পিচ্ছিল পথ। যে কোন সময়ই পা পিছলে পাহাড় থেকে একেবারে গিরিখাতে পড়ে যেতে পারেন। [৮০]

এই অন্তর্গুরুর দেখা পেতে হলে ধ্যানের বিশেষ স্তরে যেতে হয়-

কমান্ড সেন্টার নির্মাণ করে সবকিছু ঠিক মত সাজানোর পর ধ্যানের বিশেষ স্তরে অন্তর্গুরুর আগমন ঘটে। অন্তর্গুরু প্রথমে সকল অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য ‘সাইকিক বর্ম প্রদান করেন যা অতীতের সকল অশুভ প্রভাব নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ভবিষ্যতের এ ধরণের প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখে।[৮২]

দেখা যাচ্ছে যে সকল অশুভ প্রভাব থেকে শিষ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এক বিশেষ ক্ষমতা আছে অন্তর্গুরুর। যে কারণে অন্তর্গুরু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলে-

আপনি যাকে মনে করেন যে, তিনি আপনাকে জীবনের পথে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারবেন, তাকেই আপনি অন্তর্গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। তবে যে ধ্যান বা মেডিটেশন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া আপনি অনুসরণ করবেন, সে প্রক্রিয়ার উদ্ভাবক বা প্রশিক্ষককে অন্তর্গুরু হিসেবে গ্রহণ করা সবসময়ই বেশি কার্যকরী। [৮২]

অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে উপরের পদ্ধতি অনুযায়ী কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক সাহেবকে অন্তর্গুরু হিসেবে গ্রহন করতে হবে। অন্তর্গুরু’র ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, তবে সবসময় যে গুরুকে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে আবার কোন নিশ্চয়তা নেই। তিন বছর নিয়মিত মেডিটেশন করার পর গুরুর দর্শন লাভ হয়েছে – এমন নজিরও আছে।[৮২]

ইসলামের দৃষ্টিতে কিছু বিষয়

এর আগে আমরা ইসলামের কিছু মূলবিষয় – বিদআত, কুফর ও শিরক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। বিদআত কিভাবে কুফরে ও শিরকের পথে নিয়ে যায় তাও আলোচনা করেছিলাম। এবার আমরা ইসলামের দৃষ্টিতে কিছু বিষয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানব (যেমন – ভবিষ্যৎগননা করা কিংবা সুফিবাদ নিয়ে ইসলাম কি বলে)।

আল্লাহর অবস্থান ও ইসলাম

লোকমুখে চালু আছে যে, আল্লাহ পাক সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত – এটা সঠিক। তবে এর অর্থ এই নয় যে তাঁর সত্তা তাঁর সৃষ্টির সাথে মিশে আছে। বরং সত্ত্বাগত ভাবে তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক এবং তিনি সাত আসমানের ওপরে আছেন এবং তিনি সৃষ্টির উর্দ্ধে অবস্থানকারী। অতএব তিনি তাঁর সত্তার দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান নন, আর মানুষের যুক্তিও তাঁর সর্বত্র বিরাজমান হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করে, কেননা যদি তিনি সর্বত্র থাকেন, তবে অর্থ এই দাঁড়ায় যে যাবতীয় আবর্জনাতেও তাঁকে পাওয়া যাবে, কিন্তু এটা তাঁর পবিত্রতার ধারণার বিরোধী, উপরন্তু আল্লাহ পাক তাঁর কিতাবে কিংবা তাঁর রাসূল (স) তাঁর হাদীসে কোথাও উল্লেখ করেননি যে তিনি সর্বত্র বিরাজমান। বরং তাঁর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি আসমানে, অর্থাৎ সাত আসমানের উপরে অবস্থিত, আর এটাই সঠিক বিশ্বাস। আল্লাহ’তালা বলেন –

তোমরা কি এটা হতে নির্ভয় হয়েছো যে, যিনি আকাশে রয়েছেন তিনি তোমাদেরকে সহ ভূমিকে ধসিয়ে দিবেন, অনন্তর তা আকস্মিকভাবে থর থর করে কাঁপতে থাকবে?[৮৩]

তাই প্রকৃতি বা অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে আল্লাহতা’লা রয়েছেন – এই চিন্তা করাটা আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে তাঁর নিজের দেয়া আয়াতেরই পরিপন্থী।

সুফিবাদ ও ইসলাম

পার্থিব লোভ লালসা ও ভোগ বিলাস যথাসম্ভব পরিত্যাগ করা ইসলাম ধর্মের একটি মৌলিক শিক্ষানীতি হলেও সন্ন্যাসবাদের কোন স্থান এখানে নেই। আজকের খ্রিষ্টধর্মে এর বহুল প্রচার থাকলেও এটা আসলে কোন ঐশী নির্দেশ নয়। ধার্মিক খ্রিষ্টানগণ যখন অনুভব করলেন বিবাহ ও ঘরসংসার করে যথেষ্ট আখিরাতমুখিতা অর্জন করা যায়না, তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানবীয় বুদ্ধি বিবেক খাটিয়ে এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন, যার ফলে তারা হয়ে পড়ল সংসার বৈরাগী। ইসলামের মাঝেও একদল মানুষ অনুরূপ নতুন পদ্ধতির সূচনা করেন যাদের আক্বীদা, কাযযকলাপ কোন কিছুই শরীয়াহ সম্মত নয়। যেমনঃ সুফীবাদের অনুসারী ও অন্যান্য কতিপয় পথভ্রষ্ট দল সৃষ্টির সাপেক্ষে আল্লাহ পাকের সত্তা ও তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ও কদর্য ধারণা পোষণ করে থাকে আর এ সম্পর্কে তাদের কিছু বাতিল পরিভাষা আছে। যেমন –

হুলুল[৮৪] – সুফী ও অন্যান্য পথভ্রষ্ট দলের পরিভাষায় হুলুল হচ্ছে সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টার অবস্থান, হতে পারে সেটা গোটা সৃষ্টিজগতে কিংবা এর কোন অংশে। গোটা সৃষ্টিজগতে স্রষ্টার অবস্থানের মতবাদ এই যে – স্রষ্টা সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সর্বত্র বিরাজমান।

ইত্তিহাদ[৮৪] – দুটো বস্তু এক হওয়াকে আরবীতে ইত্তিহাদ বলা হয়। পথভ্রষ্টদের পরিভাষায় ইত্তিহাদ হল এই ধারণা যে স্রষ্টা ও সৃষ্টি অথবা এর কোন অংশ প্রকৃতপক্ষে একই সত্তা। স্রষ্টা ও গোটা সৃষ্টি একই সত্তা হওয়ার মতবাদকে ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’(وَحْدَة الوُجُود)[৮৫] বলা হয়। যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির কোন অংশ একই সত্তা হওয়ায় বিশ্বাসী তারা ধারণা করে যে নবী, সৎকর্মশীল, দার্শনিক প্রকৃতির লোকেরা স্রষ্টারই অংশ।

হুলুল ও ইত্তিহাদের ধারণা সুস্পষ্ট কুফর ও ধর্মদ্রোহিতা, আর এর মধ্যে নিকৃষ্টতার দিক থেকে ইত্তিহাদ হুলুলের চেয়েও মারাত্মক, কারণ তা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে এক সত্তায় পরিণত করেছে।

জ্যোতিষশাস্ত্র ও ইসলাম

আল-কুরআন এবং হাদীসে দিনের আলোর মত স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে গায়েবের জ্ঞান বা অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহ পাকের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্য, এতে কারও কোন অংশীদারিত্ব নেই। গায়েবের জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে এমন সবকিছু যা মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা জানা যায় না। সেটা হতে পারে অতীতের ঘটনা, কিংবা ভবিষ্যতের ঘটনা কিংবা দূরত্বের কারণে মানুষের জ্ঞান থেকে অন্তরালে থাকা কিছু যেমন জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহ পাক চাইলে তাঁর সৃষ্টির কোন অংশকে জানাতে পারেন, যেমন তিনি রাসুল (স) মারফত আমাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের বিবরণ জানিয়েছেন। তেমনি আল্লাহ পাক পৃথিবীতে মানুষের রিযিকের বিলিবন্টন সংক্রান্ত তথ্য ফেরেশতাগণের নিকট প্রকাশ করলে তাঁরা তা জানতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে নবী-রাসূল কিংবা ফেরেশতারা গায়েব জানেন, বরং গায়েবের জ্ঞানের একাংশ আল্লাহ পাক তাদেরকে জানালে তবেই কেবল তারা তা জানতে পারে। আর তাই এটি ইসলামী আকীদার একটি অন্যতম মূলনীতি যে গায়েবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ পাকের বৈশিষ্ট্য, এই বৈশিষ্ট্য কারও প্রতি আরোপ করলে তাকে আল্লাহর সমকক্ষ করা হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা বলেন –

বল, ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না কখন তাদের পুনরুত্থান হবে।[৮৬]

জ্যোতিষশাস্ত্র, রাশিচক্র এবং অনুরূপ ভ্রান্ত বিদ্যাগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থা ও অবস্থান দেখে কোন ঘটনা, ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা। এই বিদ্যাচর্চার দুটি তাওহীদ বিরোধী দিক রয়েছেঃ

  • প্রথমতঃ এই ধারণা করা যে গ্রহ-নক্ষত্র মহাবিশ্বের ঘটনাবলীকে সৃষ্টি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে, এই ধারণা মূলত রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করার সমতুল্য।
  • দ্বিতীয়তঃ গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান থেকে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ণয়ের চেষ্টা, যা কিনা আল্লাহ পাকের অদৃশ্যের জ্ঞানের একচ্ছত্র বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অপরকে শরীক করার শামিল।

জ্যোতিষশাস্ত্র ইসলাম ধর্মে পুরোপুরি হারাম। কারণ এতে বিশ্বাস করা হচ্ছে যে আল্লাহতা’লা নন বরং গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানই মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অনেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের (Astrology) সাথে জ্যোতির্বিদ্যাকে (Astronomy) মিলিয়ে ফেলেন। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। জ্যোতিষশাস্ত্রে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দেখে মানুষের ভাগ্য বলে দেয়া হয়। আর জ্যোতির্বিদ্যায় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের উপর নির্ভর করে গানিতিকভাবে হিসেব করে সময়, ঋতুচক্র, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি নির্ণয় করা হয় (যেমন প্রাচীনকালে নামাজের সময়সূচী ও ইসলামিক বর্ষপঞ্জী তৈরি করার কাজে জ্যোতির্বিদ্যার অংকপ্রণালী ব্যবহার করা হত)। এ প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনের আলকুদ্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর হুসাম আলদ্বীন ইবনে মুসা আফানা’র ভাষ্য –

First of all, it is worth noting that the Arabs knew astronomy a long time ago. They would predict time through observing the movements of stars. According to the scholars of Shar`iah, there are two terms confused in many people’s minds when it comes to dealing with the question in hand. These terms are astronomy and astrology. Astronomy is the science that deals with studying the movements of the celestial bodies and reducing observations to mathematical order. That science is useful in determining time, seasons, the direction of Prayer, etc. Astrology, on the other hand, is concerned with studying the positions and aspects of celestial bodies in the belief that they have an influence on the course of natural earthly occurrences and human affairs. Astrologists believe that the movements of stars have an influence on people’s lives. Both Muslim astronomers and [religious] scholars refuse the prophecies of astrologists.[৮৭]

অর্থাৎ ইসলামে জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা ভবিষ্যৎগণনার কোন স্থানই নেই।

জ্বিন জগৎ ও ইসলাম

জ্বিন জাতি কুরআনে বর্ণিত এক অতিপ্রাকৃত সত্তা। আরবি জ্বিন শব্দটির আক্ষরিক শব্দার্থ যে কোন কিছু যা গুপ্ত, অদৃশ্য, অন্তরালে বসবাসকারী বা অনেক দূরবর্তী।[৮৮] পৃথিবীতে মানুষের আগমনের আগে থেকেই তাদের অস্তিত্ব ছিল, এখনও তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। মানুষ তাদের দেখতে পায়না, তবে জিনরা মানুষকে দেখতে পায়। তারা বিশেষ কিছু শক্তির অধিকারী। মানুষের মত তাদের মধ্যেও ভালো ও খারাপ ভেদাভেদ রয়েছে।

কুরআনের ৭২তম সুরা আল জ্বিন এ শুধু জ্বিনদের নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সূরা আন নাস এর শেষ অংশে জ্বিন জাতির উল্লেখ আছে। জ্বীনদের সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহতা’লা বলেন-

আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।[৮৯]

হযরত সুলায়মান (আ) এর সেনাদলে জিনদের অংশগ্রহণ ছিল বলে কুরআনে উল্লেখ আছে –

সুলায়মানের সম্মুখে সমবেত করা হল তার বাহিনীকে – জিন, মানুষ ও পাখিদেরকে এবং তাদেরকে বিন্যস্ত করা হল বিভিন্ন ব্যুহে।[৯০]

কুরআনে আরো বলা আছে হযরত মুহাম্মদ (স) কে জিন এবং মানবজাতির নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।[৯১][৯২] অর্থাৎ ইসলামে কোনভাবেই জ্বীনদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবার উপায় নেই। জ্বিনরা বিশেষ কিছু শক্তির অধিকারী। বিশিষ্ট ইসলামিক পন্ডিত ইবন তাইমিয়াহ’র মতে যাদুকরদের যাদুর নেপথ্যে রয়েছে জ্বিনদের বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োগ। এর প্রয়োগেই যাদুকররা কোন জিনিসকে শূন্যে ভাসিয়ে ফেলত, ভাগ্যগননাকারীরা ভবিষ্যৎ জেনে নিত আর আধ্যাত্মিক গুরুরা যখন আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করত তখন ভাওতাবাজী করার জন্য জ্বিনরা মৃত মানুষের গলার স্বর নকল করে কথা বলত।[৯২] সাধু সন্ন্যাসী, ভাগ্যগণক, যাদুটোনা চর্চাকারীদের দ্বারা সংঘটিত নানা অলোকিক ঘটনা দেখে বহু মানুষ তাদেরকে আল্লাহর প্রিয় পাত্র ভাবা শুরু করে এবং তাদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার আতিশয্যে তারা যা বলে তাই করতে থাকে। পুরো ব্যাপারটিই ঘটে জ্বিনজগত সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার কারণে। মানুষের মাঝে একদল লোক যাদুটোনা, ভাগ্যগণনা জাতীয় বাতিল ও নিষিদ্ধ বিষয় চর্চার জন্য জ্বিনদের সাহায্য নেয়, তারা শয়তান জ্বিনদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানাপ্রকার শিরকী ও কুফরী কাজ করে, জ্বিনদের ইবাদত করে, ফলে শয়তান জ্বিনেরা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে এই সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় চর্চায় সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতা’লা বলেন –

আর যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে সমবেত করবেন। সেদিন বলবেন, “হে জ্বিনের দল, মানুষের অনেককে তোমরা বিভ্রান্ত করেছিলে” এবং মানুষদের মধ্য থেকে তাদের সঙ্গীরা বলবে, “হে আমাদের রব, আমরা একে অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং আমরা পৌঁছে গিয়েছি সেই সময়ে, যা আপনি আমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” তিনি বলবেন, “আগুন তোমাদের ঠিকানা, তোমরা সেখানে স্থায়ী হবে। তবে আল্লাহ যা চান তা ব্যতীত।” নিশ্চয় তোমার রব বিজ্ঞ, সর্বজ্ঞ। [৯৩]

অর্থাৎ আমাদের চারপাশে মানুষের করা অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতার যেসব প্রয়োগ দেখা যায়, যা সাধারণ চোখে অলৌকিক বলে মনে হয় তা আসলে জ্বিনদের ঘটানো ব্যাপার-স্যাপার। আর এসব কাজে জ্বিনদের সাহায্য নেবার ব্যাপারে আল্লাহতা’লা সাহায্যকারীদের জাহান্নামের বার্তা দিয়েছেন।

কোয়ান্টাম মেথড ও ইসলাম

মেডিটেশন

ইসলামে মেডিটেশন বা ধ্যান করার ব্যাপারে কোন কিছু উল্লেখ করা নেই। অনেকে দাবী করেন যে, রাসূল (স) হেরা গুহায় ধ্যান করতেন। তাদের খুব স্পষ্টভাবে জেনে রাখা প্রয়োজন যে –

  • রাসূল (স) হেরা গুহায় ঠিক কি করতেন, যা করতেন সেটাকে ধ্যান বলে আখ্যায়িত করা যায় কিনা এ ব্যাপারে আমাদের কোন বিস্তারিত তথ্য জানা নেই।
  • যদি বা তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, রাসূল (স) হেরা গুহায় ধ্যান করতেন, তবে তা করতেন নব্যুয়তের আগে। নব্যুয়তের আগে তাঁর করা কোন কাজ আমাদের জন্য শরীয়াতের উৎস নয়।

কোন সহীহ হাদীস নেই যেখানে বলা হয়েছে যে রাসুল (স) ধ্যান করতেন, কিংবা তাঁর সাহাবীরা ধ্যান করতেন, কিংবা রাসুল (স) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে ধ্যান করতেন কিংবা রাসুল (স) তাঁর উম্মতদের ধ্যান করতে বলে গেছেন। এরকম কোন নজীরও নেই। রাসুল (স) এর জীবনযাপন ছিল খোলা বইয়ের পাতার মত – সবাই জানতেন তিনি কিভাবে জীবনযাপন করেন। উম্মতরা যাতে সহজেই তাঁকে অনুসরণ করতে পারেন সেজন্য তাঁর সব কথা আর কাজই হাদীস গ্রন্থে আশ্রয় পেয়েছে। তাঁর করা সকল ইবাদতই কুরআন-হাদীসের মাধ্যমে সবাই জানেন – তাহাজ্জুদ, ইশরাক প্রভৃতি সকল ইবাদত তিনি করেছেন, তাঁকে দেখে তাঁর সাহাবীরা করেছেন এবং এভাবে কালপরিক্রমায় আমরাও তা করছি। কিন্তু তিনি সবাইকে নিয়ে জামাতে ধ্যান করতেন – এরকম কোন নজীর নেই।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবী করছে যে মেডিটেশন ব্যাপারটা ইসলামে আছে। তাদের কথানুযায়ী রাসুল (স) মেডিটেশন করতেন, কিন্তু আমাদের উপর তা চাপিয়ে দেননি।[৯৪] যদিও কোন সহীহ হাদীস এটাকে সমর্থন করেনা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলছে যে কুরআনে সরাসরি বলা আছে মেডিটেশনের কথা –

সূরা আলে ইমরানের ১৯০-৯১ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয়’। [৯৫]

যথার্থই আল কোরআন বলে, ‘আমি একটি বিষয়ে সতর্ক করছি, আল্লাহর সামনে দাঁড়াও একক বা যৌথভাবে এবং চিন্তা কর…’। এখানে ‘একক বা যৌথভাবে’ অর্থ হচ্ছে সামাজিক বা ব্যক্তিগত সংস্কারের প্রভাব বা চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণ করা। তিনি ইবাদতের একটি মাধ্যম হিসেবে ধ্যানের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। [৯৫]

অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের চোখে ধ্যান বা মেডিটেশন হচ্ছে ইবাদত। এবার আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ব্যবহার করা সুরা আল ইমরানের ১৯০-১৯১ আয়াত দুটো ভালো করে দেখি –

১৯০। নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্য
১৯১। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে দোজখের শাস্তি হতে রক্ষা কর। [৯৬]

অর্থাৎ আল্লাহতা’লা এখানে সেসব জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের কথা বলেছেন যারা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে ভীত হয়ে তাঁর কাছে আশ্রয় চায়। এখানে ধ্যান করার কথা বলা হয়নি, বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। এখানে “চিন্তাভাবনা” বলতে সেই চিন্তাভাবনাকে বলা হয়েছে যা সাধারণ একজন মানুষ করে থাকে, যেমনটি করেন বিজ্ঞানীরা ও গবেষকরা কোন কিছু বের করার জন্য, যেমনটি করে একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে বসে। গবেষকরা নিশ্চয়ই কোন সমাধানের জন্য কোয়ান্টাভঙ্গিতে বসে ধ্যান করেননা। প্রচুর বই, জার্নাল পড়ে এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম সাহায্য নিয়েই তারা তাদের সমস্যা সমাধান করেন। এবার আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ব্যবহার করা পরের আয়াতে আসি যা সুরা সাবা’র ৪৬ নাম্বার আয়াত –

বল, “আমি তোমাদেরকে একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি: তোমরা আল্ল্লাহর উদ্দেশ্যে দুই-দুইজন অথবা এক-একজন করে দাঁড়াও, অতঃপর তোমরা চিন্তা করে দেখ – তোমাদের সঙ্গী আদৌ উন্মাদ নয়। সে তো আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে তোমাদের সতর্ককারী মাত্র।” [৯৬]

এখানেও ধ্যান করার কথা বলা হয়নি। এমনকি ইবাদতের মাধ্যম হিসেবেও ধ্যানের কথা বলা হয়নি। এখানে আল্লাহর আযাব সম্পর্কে সতর্ককারী নবী-রাসুলদের যে লোকজন উন্মাদ বলে মনে করতেন, সে সম্পর্কে আল্লাহতা’লা সতর্কবাণী হিসেবে আয়াতটি নাযিল করেন। ধ্যান বা মেডিটেশনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলে যে হাদীসেও ধ্যানের কথা বলা আছে –

হযরত ইবনে আববাস থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, এক ঘণ্টার ধ্যান সারা বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এছাড়া হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে, নবীজী (স) বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম (মেশকাত)।[৯৫]

এই হাদীসটিকে ইবন আল-জাওয়াজীসহ[৯৭] অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ জাল হাদীস বলে চিহ্নিত করেছেন।[৯৮][৯৯] অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এক জায়গায় বলছে যে রাসুল (স)’র আমলে মেডিটেশন জিনিসটা ছিলনা –

এখন বলবেন, মেডিটেশন নতুন জিনিস, নবীজীর (স) যুগে তো এই মেডিটেশন ছিলো না, কোয়ান্টাম মেথড ছিলো না, মেডিটেশন করার প্রয়োজনটা কী? আসলে নবীজীর সময়ে এত টেনশন ছিলো না, এত যান্ত্রিকতা, এত প্রতিযোগিতা ছিলো না। তখন মানুষ উত্তেজিত হতো আবার ঠান্ডাও হতো। কিন্তু এখন মানুষ উত্তেজিত হয়, কিন্তু ঠান্ডা হয় না। যার ফলে সে সত্যকে অনুসরণ করতে পারে না। [১০০]

তো ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? উনারাই একবার বলছেন যে মেডিটেশন রাসুল (স)’র আমলে ছিলনা, আবার উনারাই কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা ও জাল হাদীস নিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করছেন যে আল্লাহতা’লা ও রাসুল (স) সবাইকে মেডিটেশন করতে বলেছেন। ব্যাপারটা একটু কেমন হয়ে গেল না? তাছাড়া ইসলাম ধর্মকে আল্লাহতা’লা পাঠিয়েছেন কিয়ামতের আগ পর্যন্ত সকল মুসলমানের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে। রাসুল (স)’র আমলে ইসলাম যেরকম ছিল, এখনো তাই আছে, ভবিষ্যতেও একই থাকবে – কখনোই কারো জন্য ইসলাম পাল্টাবেনা। তাই রাসুল (স) এর আমলে দরকার ছিলনা দেখে ইসলামে মেডিটেশন ছিলনা, কিন্তু এখন দরকার তাই ইসলামে মেডিটেশন চলে আসছে – এই ধারণাটাই তো বিশাল একটা গোলমেলে ব্যাপার!

ধ্যান বা মেডিটেশন জিনিসটা ইসলামে আছে কি নেই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার আগে মেডিটেশনের উৎপত্তিটা জানা দরকার আমাদের। ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই যে মেডিটেশন বা ধ্যান জিনিসটা আসলে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এসেছে –

Some of the earliest written records of meditation (Dhyana), come from the Hindu traditions of Vedantism around 1500 BCE. The Vedas discuss the meditative traditions of ancient India. Around the 6th to 5th centuries BCE, other forms of meditation developed in Taoist China and Buddhist India. Dhyana in early Buddhism also takes influence on Vedanta by ca. the 4th century BCE.[১০১]

ইসলামের ভেতর ধ্যান জিনিসটা আসে অনেক পরে, সুফিবাদের হাত ধরে –

Sufi view or Islamic mysticism involves meditative practices. Remembrance of God in Islam, which is known by the concept Dhikr is interpreted in different meditative techniques in Sufism or Islamic mysticism. This became one of the essential elements of Sufism as it was systematized in the 11th and 12th centuries. It is juxtaposed with fikr (thinking) which leads to knowledge. By the 12th century, the practice of Sufism included specific meditative techniques, and its followers practiced breathing controls and the repetition of holy words.[১০১]

অর্থাৎ সুফি সাধকরা ইসলামে ধ্যান বা মেডিটেশনের প্রচলন করেন, রাসুল (স) এর কাছ থেকে ধ্যান বা মেডিটেশন নিয়ে কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি। সুফিদের মাধ্যমে কিভাবে হিন্দু ধর্মের একটা আচার ধ্যান ইসলামে আসে তার ইতিহাস থেকে আমরা দেখি যে –

The mystic tradition began to find expression among Muslims from about 8th century CE, a century after the borders of the Islamic state had expanded to include Egypt and Syria and its major centers of monasticism. A group of Muslims who were not satisfied with what the Sharee’ah (Islamic Law) had to offer, developed a parallel system which they named the Tareeqah (the way). Just as the ultimate goal of the Hindu was unity with the world soul and of the Christian mystic union with God; the ultimate goal of this movement became Fanaa, the dissolution of the ego, and Wusool the meeting and unification of the human soul with Allaah in this life. A series of preliminary stages and states which had to be attained were defined. They were called Maqaamaat (stations) and Haalaat (states). A system of spiritual exercises was also designed for the initiate in order to bring about this “meeting.” These exercises of “Dhikr” often involved head and body movements and sometimes even dance, as in the case of whirling dervishes.[১০২]

এবার আমরা যদি কোয়ান্টাম মেথডের ধ্যানের ইতিহাস নিয়ে বসি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে এটারও আগমন হিন্দু ধর্ম থেকে –

The science of Quantum Mechanics now concurs with the ancient wisdom of Hindu Vedanta philosophy, in the observation that the sense-bound intellect alone is simply inadequate for experiencing the ultimate condition of reality. [১০৩]

স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনের যে দর্শন অর্থাৎ ইত্তিহাদের কথাই এখানে চলে এসেছে। ইসলামে ধ্যান নিয়ে কোন ধারণাই ছিলনা, এটার আগমন হয় মূলত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম থেকে। অর্থাৎ ধ্যান বা মেডিটেশন এমন একটা ইবাদত যেটা রাসুল (স) এর আমলে ছিলনা এবং যা হাদীস কুরআন দিয়ে সমর্থিত নয়। তাই এটাকে নিঃসংকোচে বিদআত এর শ্রেনীতে ফেলা যায়। উপরন্তু ধ্যান জিনিসটা এসেছে অন্য ধর্ম থেকে। অন্য ধর্মকে অনুসরণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। অন্য ধর্মের আচার অনুসরণ করার মানে হচ্ছে, আল্লাহতা’লা ইসলাম হিসেবে আপনাকে যা দিয়েছেন তা আপনার কাছে সঠিক ও পর্যাপ্ত মনে হচ্ছেনা। আপনার মনে হচ্ছে অন্য ধর্মের কোন একটা (বা একাধিক) ব্যাপার বা ধারণা আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীনের চেয়েও অনেক ভালো। চিন্তা করুন কত বড় ভয়ানক একটা ধারণা এটি! এ ব্যাপারে আল্লাহতা’লা বলেন –

আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [৪১]

তাই অন্য ধর্মের কোন কিছু বরণ করে নেয়া মানে হল আপনি কুফরি করছেন। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? ধ্যান একটা বিদআত যা এসেছে অন্য ধর্ম থেকে অর্থাৎ এটা কুফরি। তাই ধ্যান একই সাথে বিদআত এবং কুফরি।

মেডিটেশনে কি কি হয়? আসুন দেখি –

ধ্যানাবস্থায় মন হয় ত্রিকালদর্শী, চেতনা অতিক্রম করে সকল বস্তুগত সীমা। মনের এই ধ্যানাবস্থার শক্তিকে প্রয়োগ করেই প্রাচ্যের সাধক দরবেশ ঋষিরা একদিন আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ইচ্ছা করেছেন-ঘটনা ঘটেছে। ইচ্ছা করেছেন-মানুষ রোগমুক্ত হয়েছে। … এই চাবিকাঠি দিয়েই দৃশ্যমান সব কিছুর পেছনে প্রকৃতির যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম কাজ করছে তার সবটাকেই আপনি নিজের ও মানবতার কল্যাণে সক্রিয় করে তুলতে পারবেন। [ ১০৪]
মেডিটেশনের মাধ্যমেই আপনি সংযোগ সাধন করতে পারেন আপনার ‘অন্তরের আমি’র সাথে, আপনার শক্তির মূল উৎসের সাথে। [১০৫]

অর্থাৎ কোয়ান্টাম মেথডের মতে মেডিটেশনে আপনি আপনার মন কে নিয়ন্ত্রণ করে চারপাশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, যেভাবে করেন সাধু-ঋষিরা। আপনার মন হবে ত্রিকালদর্শী অর্থাৎ ভবিষ্যৎ জেনে নিতে পারবেন আপনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মনে করে মনের শক্তি অসীম।[১০৬] এই অসীম ক্ষমতাধর মনকে নিয়ন্ত্রন করে কি কি করা সম্ভব তার একটা উদাহরণ নিচে দেয়া হল –

ট্রাফিক যখন ডানে-বামে কোনোদিকেই নড়াচড়া করছে না আমাদের অনেক গ্রাজুয়েট তখন উত্তেজিত না হয়ে এই ভঙ্গি (কোয়ান্টা ভঙ্গি) করে অপেক্ষা করেন। দেখা যায়, যাওয়ার পথ সহজ হয়ে গেছে। অথবা শীতের রাত, চারটায় হাইওয়েতে যানবাহন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ভঙ্গি করে অপেক্ষা করছেন যানবাহন চলে আসছে। অথবা-সব গাড়ি উত্তর দিকে যাবে, দক্ষিণে কোনো গাড়ি যাবে না। এই ভঙ্গি করে অপেক্ষা করছেন দক্ষিণের গাড়ি চলে আসছে। অতিরিক্ত ভাড়া চাচ্ছে, এই ভঙ্গি করে অপেক্ষা করছেন, ন্যায্য ভাড়ায় যানবাহন পাওয়া যাচ্ছে। [১০৭]

অন্তরের ইবাদতসমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল “তাওয়াক্কুল” (বা ভরসা করা) – যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ওপর করা যাবে না। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া এমন কোন সত্তার ওপর এমন কোন ব্যাপারে তাওয়াক্কুল করে যা সংঘটনের ক্ষমতা তার নেই, তবে তা বড় শিরক হবে যা একজন ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডীর বাইরে নিয়ে যায়। মেডিটেশন পদ্ধতিতে নিজের ওপর “তাওয়াক্কুল” ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার শিক্ষা দেয়া হয়, বলা হয় যে আপনি চাইলেই সব করতে পারেন। এমনকি ইচ্ছা করলে প্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন –

ব্যক্তিমন ও চেতনা সংযুক্ত হয় মহাচেতনা বা কসমিক কনশাসনেসের সাথে। তখন অর্জিত হয় দৃশ্যমান সবকিছুর পেছনে প্রকৃতির যে নেপথ্য স্পন্দন ও নিয়ম ক্রিয়াশীল তাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা।[৭৪]

ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো তাহলে? আপনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। যা করা আল্লাহর এখতিয়ারে, আপনি বিশ্বাস করছেন যে আপনার অসীম শক্তিধর মন সেটা করে ফেলতে পারছে। মনের স্বাধীন শক্তির এই ধারণাটি ইসলামের শিক্ষার সাথে রীতিমত সাংঘর্ষিক। মনের এমন কোন ক্ষমতা নেই, যা প্রকৃতির নেপথ্য শক্তিকে (আল্লাহ ব্যতীত আর কোন শক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করাই শিরক) নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জৈবিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা বা স্থান-কালের ঊর্দ্ধে যেতে পারাও সম্ভব নয় মানব আত্মার পক্ষে।

কিছুক্ষণ আগেই আমরা দেখলাম যে ধ্যান জিনিসটা বিদআত এবং কুফরের আওতায় পড়ে। এখন দেখলাম যে মনের অসীম ক্ষমতার উপর বিশ্বাস ধ্যান ব্যাপারটাকে শিরকের আওতায়ও ফেলে দিচ্ছে!

আরেকটি ব্যাপার একটু পরিস্কার হওয়া দরকার। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলে আসছে যে নামাযের সাথে মেডিটেশনের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে –

নামাজ ঠিকভাবে পড়ার জন্যে মনোযোগ প্রয়োজন। আর মেডিটেশন মানুষের মনকে বর্তমানে নিয়ে আসে। যখন আপনি মনকে বর্তমানে নিয়ে আসতে পারবেন, মনোযোগকে একাগ্র করতে পারবেন, আল্লাহকে হাজির-নাজির হিসেবে অনুভব করতে পারবেন তখন সেই নামাজ আপনি পড়তে পারবেন-যে নামাজ মানুষকে প্রশান্ত করতে পারে। তখন আপনি বলতে পারবেন-নামাজই যথেষ্ট। কিন্তু ঐ স্তরে যেতে হলে মেডিটেশন প্রয়োজন।[১০৮]

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় তো প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ফরজ, যা অবশ্য পালনীয়। কোনো মুসলমান যদি তা না করে তাহলে ধর্মের একটি আবশ্যকীয় লঙ্ঘনের দোষে সে দোষী হবে। কিন্তু পাঁচবার নামাজ আদায় করলেই কি সব হয়ে গেল? … তাছাড়া নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির জন্যেও মেডিটেশন করা উচিত।[১০৯]

অধিকাংশই খুব দুঃখ করে বলেছেন যে, আমরা তো বলি হুদরিল ক্বাল্ব ছাড়া নামাজ হয় না। শুধু রুকু-সেজদা দিলে, সূরা-কেরাত পড়লে নামাজ হয় না। নামাজের জন্যে প্রয়োজন হুদরিল ক্বাল্ব বা একাগ্রচিত্ততা। এই হুদরীল ক্বালব কীভাবে সৃষ্টি করতে হয় এখানে এসে শিখে গেলাম। তাই যারা ইবাদত-বন্দেগিতে একাগ্রচিত্ত হতে চান মেডিটেশন তাদেরকে চমৎকারভাবে সাহায্য করবে।[১১০]

শুধু নামাজই নয় বরং কুরআন-হাদীস চর্চায়ও মেডিটেশন জিনিসটা দরকার বলে মনে করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন –

সঠিকভাবে আপনি যাতে কোরআন এবং হাদীস অনুধাবন করতে পারেন, অধ্যয়ন করতে পারেন, হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন- এজন্যে মাথাটাকে ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। আর এ জন্যেই মেডিটেশন। ব্রেনটাকে বেশি করে ব্যবহার করতে মেডিটেশনের বিকল্প নেই।[১১১]

অর্থাৎ আপনি নামাজ পড়ুন বা কুরআন-হাদীস পড়ুন, মনোযোগ বা একাগ্রচিত্তের জন্য আপনাকে মেডিটেশন করতে হবে। তার মানে হল ইবাদতে একাগ্রচিত্ততা আনার অপরিহার্য এক অংশ হচ্ছে মেডিটেশন। ছোট্ট একটা সমস্যা রয়ে গেছে এখানে – কুরআন বা হাদীসে কোথাও মেডিটেশনকে ইবাদত কিংবা ইবাদতের অপরিহার্য কিছু বলে উল্লেখই করা হয়নি। নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য রাসুল (স), তাঁর চার খলিফা কিংবা তাঁর সাহাবীগণ – কাউকেই নামাজের আগে কিংবা কুরআন পাঠের আগে মেডিটেশন করতে দেখা যায়নি। তাই নামাযের পূর্বশর্ত হিসেবে মেডিটেশন দরকার – কথাটা কেমন যেন গোলমেলে। তাছাড়া রাসুলের সুন্নতে যেহেতু মেডিটেশন করার কোন উল্লেখ নেই তাই বলা যায় যে ইসলামের সাথে এর কোনই সম্পৃক্ততা নেই। উপরন্তু এটি এসেছে অন্য ধর্মের উপাসনা/তপস্যা থেকে। তাই এটা ইসলাম পরিপন্থী। এটা যে অন্য ধর্ম হতে আগত সেটা আগেও মেডিটেশনের ইতিহাস থেকে দেখেছি। তারপরও আমরা কোয়ান্টাম মেথডে ব্যবহৃত কিছু শব্দ দেখব, যেগুলো মূলত অন্য ধর্মের উপাসনায় ব্যবহৃত হয় এবং এগুলোর উৎপত্তিও ঐসব ধর্ম থেকে। এর একটি হচ্ছে “নির্বাণ” যাকে শিথিলায়নের চেয়ে ধ্যানের একটি উচ্চস্তর হিসেবে বলা হয়েছে [১১২] আর অন্যটি হচ্ছে “কুন্ডলিনী”, যা কোয়ান্টাম মেথড রিয়েলাইজেশন কোর্স এ শিক্ষা দেয়া হয় [১১৩]। নির্বাণ সম্পর্কে বলতে হলে বলতে হয়-

Nirvāṇa (Sanskrit: निर्वाण; Pali: निब्बान nibbāna ; Prakrit: णिव्वाण) is an ancient Sanskrit term used in Indian religions to describe the profound peace of mind that is acquired with moksha (liberation). In shramanic thought, it is the state of being free from suffering. In Hindu philosophy, it is union with the Brahman (Supreme Being). The word literally means “blown out” (as in a candle) and refers, in the Buddhist context, to the imperturbable stillness of mind after the fires of desire, aversion, and delusion have been finally extinguished. [১১৪]

কুন্ডলিনী সম্পর্কে –

Kundalini (kuṇḍalinī, Tamil: குண்டலினி/வாலை, Sanskrit: कुण्डलिनी, Thai: กุณฺฑลิน) literally means coiled. In yoga, a “corporeal energy” – an unconscious, instinctive or libidinal force or Shakti, lies coiled at the base of the spine. It is envisioned either as a goddess or else as a sleeping serpent, hence a number of English renderings of the term such as “serpent power”. It is reported that kundalini awakening results in deep meditation, enlightenment and bliss. In practical terms, one of the most commonly reported Kundalini experiences is the feeling of an electric current running along the spine. [১১৫]

ঘুরেফিরে সবকিছুই সেই হিন্দু অথবা বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই আসছে। তাহলে ইসলামের কি থাকল এখানে? না জেনে শুনে কোয়ান্টাম মেডিটেশন করে আসলেই কি আমরা ইসলামকে জলাঞ্জলী দিচ্ছি?

মাটির ব্যাংক

আগের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম যে মাটির ব্যাংককে আসলে কল্যান পাবার শর্টকাট একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে – যেমন, ফাইল হারিয়ে গেছে তো মাটির ব্যাংকে টাকা রাখুন হারানো ফাইল চলে আসবে, ব্যবসায় উন্নতি দরকার তো মাটির ব্যাংকে টাকা রাখুন দ্রুত সাফল্য আসবে, বাড়ীঘর বিক্রি করতে চান তো মাটির ব্যাংকে টাকা রাখুন অধিক দামে বিক্রি হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ এখানে ধরে নেয়া হচ্ছে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখলে মানুষের কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে, অথচ ইসলামী শিক্ষা হল কল্যাণ একমাত্র আল্লাহ পাকের কাছ থেকেই আসে, আর কারও জন্য কোন ক্ষতি নির্ধারিত হলে সেটাও একমাত্র আল্লাহ তা’আলার নিয়ন্ত্রণে, আল্লাহর সাথে এতে কোন অংশীদার নেই। তাই মাটির ব্যাংকে টাকা দিলে জীবনে কল্যান-উন্নতি আসে এমনটা ধারণা করলে অর্থাৎ মাটির ব্যাংককে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করলে তা শিরক হবে।

আর যদি দাবী করা হয় যে মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার কারণে কল্যাণ ত্বরান্বিত হয়, অর্থাৎ মাটির ব্যাংকে টাকা দিলে নিমিষেই আল্লাহ আপনার মনোবাসনা পূরণ করবেন তবে কোন ঘটনার উপকরণ বা “সাবাব” হিসেবে এমন কিছুকে নির্ধারণ করা হল, যাকে আল্লাহ পাক সেই ঘটনার উপকরণ বা সাবাব হিসেবে নির্ধারণ করেননি। অবস্থাভেদে এটা বড় বা ছোট শিরক হতে পারে। এই কারণেই তাবিজ এর ব্যবহার ইসলামে নিষিদ্ধ।

এখানে আরো কিছু ব্যাপার আছে। যেমন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মানত ও দানকে একই কাতারে ফেলে দিয়েছে।[১১৬] অথচ দান ও মানত সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন জিনিস। দান হতে হবে নিঃশর্ত এবং তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য নয়। অর্থাৎ দান করার সময় আপনি কোন শর্ত আরোপ করে দেবেননা – যদি আমার অমুক ইচ্ছা পূরণ হয় তবেই আমি দান করব – এরকম কোন কিছু হলে সেটা দান হয়না বরং সেটা মানত হয়ে যায়। মানত এ নিজের স্বার্থ জড়িত থাকে এবং তা হয় শর্তযুক্ত। সোজা কথায়, কোনো বিষয় অর্জিত হওয়ার শর্তে কোনো কিছু করার ওয়াদাকে সাধারণত আমরা মানত বলে থাকি। যেমন আমরা কখনো কখনো বলি, যদি আমি পরীক্ষায় পাশ করি তাহলে মাদ্রাসায় একটি ছাগল জবাই করব। এটি একটি মানত।

আসলে মানত করা ঠিক নয়। রাসুল (স) মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না। বরং মনে করি মানত করা খুব সওয়াবের কাজ। আসলে এটি কোনো সওয়াবের কাজ নয়। মানত প্রসঙ্গে হাদীসে আছে –

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।[১১৭]

সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।[১১৮]

উপরের হাদীস দুটোর সারমর্ম হচ্ছে যে রাসূল (স) তাঁর উম্মতদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। তাই আমাদের উচিত হবে কোনো অবস্থায় মানত না করা। অবশ্য মানত করে ফেললে তা পালন করতেই হবে কারণ মানত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। এ ব্যাপারে আমরা একটু পরই দেখছি। মানত করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় – এ কথা বলে রাসূল (স) বুঝিয়েছেন, মানত করা একটি অনর্থক কাজ। সাধারণত কৃপণ স্বভাবের লোকেরা মানত করে থাকে। তারা সুস্থ ও নিরাপদ থাকা কালে দান-সদকা করে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আল্লাহর পথে খরচ বা দান সদকা করার বড় বড় মানত করে। তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। তাকদীরের প্রতি যাদের যথাযথ ঈমান নেই সাধারণত তারাই মানত করে থাকে। অর্থাৎ মানত করা হোক বা না হোক – ফলাফল একই হবে।

তবে হ্যাঁ – মানত করলে তা আদায় করতেই হবে। কেউ যদি কোনো ভাল কাজ করার মানত করে তাহলে তাকে তা পালন করতেই হবে। যাকে আমরা বলি মানত পুরো করা। মানত পুরো করা ওয়াজিব, না করলে গুনাহ হবে[১১৯]। মানত সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা বলেন –

তারা যেন তাদের মানতসমূহ পূরণ করে।[১২০]

তোমরা যা কিছু ব্যয় কর অথবা যে কোনো মানত কর তা অবশ্যই আল্লাহ জানেন।[১২১]

আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল ঈমানদারদের প্রশংসায় বলেন-

তারা মানত পূরণ করে।[১২২]

অর্থাৎ মানত করলে তা পূরণ করতেই হবে। আল্লাহ তাআলা মানত পূরণ করতে হুকুম করেছেন। তবে কুরআনের কোথাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানত করতে আদেশ করেননি বা উৎসাহ দেননি (যেমনটি তিনি দিয়েছেন দানের ব্যাপারে) কিংবা অন্য কোনো আয়াতেও দিয়েছেন এমনটি পাওয়া যায়নি। কেউ মানত করলে কিংবা কোনো খরচ করলে আল্লাহ তা ভালভাবেই জানেন। তাই কেউ যদি মানত করে তবে মানত পূরণ না করে কোনো উপায় নেই।

তাছাড়া কোন কিছু চাইবার জন্য আল্লাহতা’লার কাছে মানত করারই বা দরকার কি? আল্লাহতা’লা আমাদের একমাত্র রব, তাঁর কাছে আমরা নিঃসংকোচে যেকোন কিছু চাইতে পারি। কোন কিছু পাবার জন্য তাঁকে শর্ত আরোপ করারই বা কি দরকার। শর্তারোপের ব্যাপারটা যেন কেমন হয়ে গেলনা? আমি আল্লাহতা’লাকে বললাম যে হে আল্লাহ আমাকে চাকরি দিয়ে দাও তাহলে আমি মাটির ব্যাংকে চাকরির প্রথম মাসের টাকা দিয়ে দেব। ব্যাপারটা অনেকটা ব্যবসায়িক চুক্তির মত হয়ে গেল, অর্থাৎ আল্লাহতা’লা যদি তাঁর কাজ সম্পাদন করেন তবে আমি আমারটা সম্পাদন করব। অথচ আল্লাহতা’লাকে এভাবে শর্ত দেবার আমি কে? আমি তো নগন্য একজন বান্দা, তাঁর উপর শর্তারোপ করার ক্ষমতা আমার আছেই বা কতটুকু?

এ কারণেই রাসুল (স) মানত করতে নিষেধ করেছেন, আর তিনি যা নিষেধ করেছেন তা করা কতটুকু সমীচীন একজন মুসলিম হিসেবে নিশ্চয়ই আপনাকে বলে দিতে হবেনা। অথচ দেখা যাচ্ছে যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সবাইকে মানত করতে এবং মানতের টাকা মাটির ব্যাংকে রাখতে নানাভাবে (একবারে মানতের টাকা যোগাড় করতে না পারলেও সমস্যা নেই, কিস্তিতে তা দেয়া যাবে) উৎসাহিত করে যাচ্ছে।[১২৩] আমাদের রাসুল (স) যা করতে নিষেধ করেছেন তাই-ই করতে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন উৎসাহ যোগাচ্ছে – ব্যাপারটা একটু কেমনতর হয়ে গেলনা?

ভবিষ্যৎ জানা ও জ্যোতিষশাস্ত্র

দান ও মানতের মতোই বিভ্রান্তিকর দুটো শব্দ হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র – একটি বিজ্ঞান আরেকটি শাস্ত্র যাতে কোন বিজ্ঞান নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astronomy) ও জ্যোতিষশাস্ত্র (Astrology) বিষয় দুটি নিয়ে আগেই আলোচনা করেছি আমরা এবং সেখানে দেখেছিলাম যে ইসলামে জ্যোতিষশাস্ত্রের কোন স্থান নেই। কারণ একজন মুসলিম বিশ্বাস করে ভবিষ্যৎ বা গায়েব কেবলমাত্র আল্লাহ তা’লা জানেন, আর কেউ তা জানেনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা বলেন –

আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না ?[১২৪]

তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুস্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে।[১২৫]

অথচ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দাবী করছে যে ইচ্ছা করলে যে কেউ ভবিষ্যৎ বা গায়েব জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে তারা কুরআনের একটি আয়াতের নিচের মত ব্যাখ্যা দিয়েছে –

পবিত্র কোরআনের সূরা জ্বীনের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘গায়েব বা ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র তিনিই জানেন, যদি না তিনি কাউকে জানান, যেমন তিনি রসুলদের জানিয়েছেন।’ অর্থাৎ জানার পথ খোলা আছে। তিনি যে কাউকে ইচ্ছা ভবিষ্যৎ জানাতে পারেন, যে কাউকে ইচ্ছা গায়েব জানাতে পারেন, এটা ওনার এখতিয়ারে। আর এটা আল্লাহর একটি আশ্বাসই যে, যে যা জানতে চায়, আল্লাহ সেই বিষয়ে তাকে জ্ঞান দান করেন।[১২৬]

অথচ সূরা জ্বিনের ২৬, ২৭ এবং ২৮ নম্বর আয়াত তিনটি হচ্ছে –

২৬। তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না,
২৭। তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। সে ক্ষেত্রে তিনি রাসূলের সামনে এবং পেছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন
২৮। রাসূলগণ তাদের প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন কি না জানবার জন্য। রাসূলগণের নিকট যা আছে তা তাঁর জানা রয়েছে এবং তিনি সমস্ত কিছুর বিস্তারিত হিসাব রাখেন। [১২৭]

অর্থাৎ রাসুল ব্যতীত আল্লাহতা’লা কাউকে তাঁর গায়েবের জ্ঞান দেননা। এবং তাঁদের গায়েবের জ্ঞান দেবার পর ফেরেশতা দ্বারা তাঁদের পরিবেষ্টিত করে দেন। তাই জানার পথ খোলা আছে, যে কেউ আল্লাহতা’লার গায়েবী জ্ঞান জেনে নিতে পারবেন – ব্যাপারাটা মোটেও সত্যি নয়। আল্লাহপা’ক বলেন –

আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য।[১২৮]

অর্থাৎ নবী রাসুলগণও গায়েব জানেননা, শুধুমাত্র আল্লাহ তাদেরকে যতটুকু জানান তাঁরা ততটুকুই জানেন। যেখানে আল্লাহতা’লা নিজেই ঘোষনা করেছেন যে মনোনীত রাসুল ব্যাতীত আর কাউকে তিনি অদৃশ্যের জ্ঞান জানান না সেখানে আমার আপনার মত নগন্য মানুষকে সেই জ্ঞান দিয়ে দেবেন – এমন চিন্তা করাটাইতো গুনাহ। অথচ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সূরা জিনের এই আয়াতটির ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে।

সমস্যা আরো আছে, ইসলামের দৃষ্টিতে জ্যোতিষশাস্ত্র হারাম কিনা – এমন প্রশ্নের[১২৯] জবাবে ইসলামে যে জ্যোতিষশাস্ত্র হালাল তা বোঝানোর জন্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আর জ্যোতিষশাস্ত্রকে এক করে একটি জগাখিচুড়ী ধরণের জবাব দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই জবাবে বলা হয়েছে যে পবিত্র কুরআনে জ্যোতিষশাস্ত্র তথা রাশিচক্রকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে –

পবিত্র কোরআনের ৮৫ নং সূরাটির নাম ‘বুরুজ’, যার মানে রাশিচক্র। আরবি ভাষায় রাশিকে বুরুজ বলা হয়।[১২৬]

যারা তাফসীরের মূলনীতিগুলো জানেন, তাদের একথা জানা যে এটি একটি ভুল অনুবাদ। আসলে বুরুজ শব্দের অর্থ বড় প্রাসাদ ও দূর্গ। অধিকাংশ তাফসীরবিদদের মতে বুরুজ অর্থ বড় বড় নক্ষত্র। কয়েকজন তাফসীরবিদ এ স্থলে অর্থ নিয়েছেন প্রাসাদ; অর্থাৎ সেইসব গৃহ যা আকাশে প্রহরী ও ফেরেশতাদের জন্য নির্ধারিত। পরবর্তীকালে কোন কোন তাফসীরবিদ দার্শনিকদের পরিভাষায় বলেছেন যে সমগ্র আকাশমন্ডলীকে বার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর প্রত্যেক ভাগকে বুরুজ বলে। তাদের ধারণা, স্থিতিশীল গ্রহ-নক্ষত্রসমূহ এসব বুরুজের মাঝেই অবস্থান করে। কিন্তু এটা সম্পূর্ন ভুল। কুরআন বলে না যে গ্রহগুলো আকাশে স্থির বরং কুরআনের মতে প্রত্যেক গ্রহ নিজস্ব গতিতে গতিশীল।[১৩০] তাই সূরা বুরুজ মানে রাশিচক্র – কথাটি সম্পূর্ণ ভুল।

তাছাড়া বলা আছে যে –

ইসলামের স্বর্ণযুগে যত বড় বড় আরব পণ্ডিত ছিলেন – আল বেরুনী থেকে শুরু করে আল বাত্তানী, আল কিন্দি, আল জারকানি, ইবনে বাজ্জা, ইবনে তোফায়েল, ইবনে আরাবী, ইব্রাহীম আল ফাযারি, আল ফারগানি, আল খারেজমি, আল তারাবি, ওমর খৈয়াম, ইবনে ইউনুস, নাসিরুদ্দিন আল তুসী প্রমুখ ইসলামি মনীষীগণ এস্ট্রলজি চর্চা করেছেন। কারণ তাদের অনুপ্রেরণা ছিলো পবিত্র কোরআনের বাণী, “নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি কর নি।”[১২৬]

সুরা আল ইমরানের ১৯০-১৯১ আয়াত দুটোর অর্থ আমরা এর আগেও বিস্তারিতভাবে দেখেছিলাম। আয়াত দুটোর সম্পূর্ণরূপ হচ্ছে –

১৯০। নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্য
১৯১। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটা নিরর্থক সৃষ্টি করনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে দোজখের শাস্তি হতে রক্ষা কর।

অর্থ্যাৎ আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি নিবিড় পর্বেক্ষণ তাকে উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহর কাছে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মাফ চাইতে যা মুসলিমের অন্যতম অন্যতম বিশ্বাস মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও বিচারদিনের বিষয়টিকেই প্রতিফলিত করে। এখানে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। এ ব্যাপারেও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন পবিত্র কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করেছে।

তাছাড়া কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে ইস্তিখারাহ সালাতকে স্বপ্নচর্চা বা স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখার একটি মাধ্যম বলে আসছে[৬০] সেটাও সম্পূর্ণ ভুল। ইস্তিখারাহ সালাতের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ দেখা যায়না। “ইস্তিখারাহ” এর অর্থ হল আল্লাহতা’লা’র কাছ থেকে কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। এর উদ্দেশ্য হল দুটি বস্তু থেকে ভালটি কামনা করা। যেমন ধরুণ আপনি দুটো ভালো কোম্পানিতে চাকরির অফার পেয়েছেন, আপনি বুঝতে পারছেননা যে কোনটি আপনার জন্য ভাল হবে। আপনি ইস্তিখারার সালাত আদায় করে আল্লাহতা’লা’র কাছে দোয়া চাইবেন যে যেটা আপনার জন্য ভাল হবে আল্লাহতা’লা যাতে আপনাকে সেটার পথেই পরিচালিত করেন। সবসময় যে স্বপ্ন মাধ্যমেই সব জেনে যাবেন এমন কোন কথা নেই, আরো অনেকভাবেই আল্লাহতা’লা আপনাকে সাহায্য করবেন, যেমন – যে চাকরিটা আপনার জন্য ভালো হবে সেটাতে জয়েন করা আপনার জন্য সুগম হয়ে যাবে আর অন্যটা হয়ে যাবে খুব কঠিন। কিংবা আরো অনেকভাবেই আল্লাহতা’লা আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।

It is not necessary that you get a dream or even a “feeling.” Rather, the istikhara is a prayer that Allah guide you towards that which is best (khayr) for you. If you do the prayer of guidance (istikhara) with the proper manners, the most important of which is to truly consign the matter to Allah and suspend your own inclinations, then Allah will make events unfold in the direction that is the best for your worldly and next-worldly affairs.[১৩১]

অর্থাৎ কোন কাজে আল্লাহতা’লার নির্দেশনা চাইবার জন্য ইস্তিখারা সালাত আদায় করা হয়, ভবিষ্যৎ দেখার জন্য নয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে অ্যাস্ট্রলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্র ও ভবিষ্যৎ জানার পক্ষে সাফাই গাইছে সেটা আসলে কত বড় গুনাহ’র কাজ। জ্যোতিষী বা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাদের নিয়ে রাসুল (স) বলেছেন –

যদি কেউ কোন গায়েবী বিষয়ের সংবাদদাতা বা ভবিষ্যদ্বক্তা’র কাছে যায় এবং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে, তবে ৪০ দিন পর্যন্ত তার কোন নামায কবুল হবে না। [১৩২]

কমান্ড সেন্টার

আগের অংশেই আমরা গায়েব বা ভবিষ্যৎ জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছি এবং কুরআন ও হাদীসের কথানুযায়ী দেখেছি যে যে এতে আল্লাহ ছাড়া আর কারো অংশীদার নেই। আমরা এও দেখেছি যে, কীভাবে কুরআনের আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে এই জঘন্য বিষয়টিকে ইসলামে অনুমোদিত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সাথে আমরা এও আলোচনা করেছি যে আমাদের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী মহান আল্লাহতা’লা, তাঁর আদেশ ছাড়া গাছের পাতাও পড়েনা। তাই ভবিষ্যৎ জেনে আগে থেকেই ভবিষ্যৎ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র আল্লাহ তা’লার এখতিয়ারে রয়েছে। কিন্তু কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে কমাণ্ডসেন্টারের প্রয়োগের যে নমুনা (টেন্ডারের ভবিষ্যৎ সর্বনিম্ন মূল্য জেনে যাওয়া বা ভিসা বোর্ডে কী রকম পরিস্থিতি হবে তা আগে ভাগেই নিয়ন্ত্রণ করা) আমরা দেখেছিলাম, তাতে মানুষকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী করছে যখন সে গায়েবের জ্ঞানের অধিকারী হয় এবং নিজের ও অন্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।[১৩৩] আর এ রকম ধারণা পোষণ করা যে কাউকেই সরাসরি শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত করে ফেলে।

অন্তর্গুরু

ইসলামের কোন পুরোহিততন্ত্র (Priesthood[১৩৪]) নেই – যা এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। পীরের মুরিদ হওয়ার কোন সুযোগ ইসলামে নেই বরং তা যে কিভাবে মানুষকে শিরকের দিকে ডাকে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তা বোঝা মোটেও কঠিন নয়। কোয়ান্টাম মেথডের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও ভয়ংকর এই কারণে যে এখানে অন্তর্গুরু কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখেন যা শিরক হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ রাখেনি। এ ব্যাপারে কোয়ান্টম মেথড বলে-

কমান্ড সেন্টার নির্মাণ করে সবকিছু ঠিকমত সাজানোর পর ধ্যানের বিশেষ স্তরে অন্তর্গুরুর আগমন ঘটে। অন্তর্গুরু প্রথমে সকল অদৃশ্য অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির জন্যে ‘সাইকিক বর্ম’ প্রদান করেন। এই সাইকিক বর্ম অতীতের সকল অশুভ প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ভবিষ্যতের এ ধরনের প্রভাব থেকে তাকে পুরোপুরি নিরাপদ রাখে।[১৩৫]

অর্থাৎ অন্তর্গুরু আপনাকে অকল্যান থেকে মুক্ত রাখবেন। অথচ আমরা জানি আমাদের অকল্যান ও অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত রাখার একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহতা’লা। যে কোন সমস্যায় আমরা তাঁর কাছেই মুক্তি চাই। আল্লাহতা’লা বলেন –

১। আপনি বলুন, আমি ঊষার প্রভুর নিকট আশ্রয় চাই।
২। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে।
৩। এবং (রাত্রির) অন্ধকারের অনিষ্ট হতে যখন তা (সবকিছু) ঢেকে ফেলে।
৪। এবং গ্রন্থিসমূহে যে সকল নারীগণ (যাদু করে) ফূৎকার দেয় তাদের অনিষ্ট হতে।
৫। আর হিংসুক যখন হিংসা করে তার অনিষ্ট হইতে।[১৩৬]

সূরা আননাস এর মূল কথাও একই। অথচ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আল্লাহ তা’লাকে বাদ দিয়ে একজন অন্তর্গুরুর উপর নিজেকে অশুভ শক্তি হতে মুক্ত রাখার জন্য নির্ভর করছে। কত বড় মাপের শিরক এটি চিন্তা করুন?

এবার চলুন আমরা দেখি যে কে হতে পারবে অন্তর্গুরু? কাকে আপনি অন্তর্গুরু হিসেবে মেনে নেবেন? এ ব্যাপারেও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দিকনির্দেশনা রয়েছে –

অন্তর্গুরু বা মুর্শিদ কে হতে পারেন? আপনি যাকে মনে করেন যে, তিনি আপনাকে জীবনের পথে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারবেন, তাকেই আপনি অন্তর্গুরু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। তবে যে ধ্যান বা মেডিটেশন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া আপনি অনুসরণ করবেন, সে প্রক্রিয়ার উদ্ভাবক বা প্রশিক্ষককে অন্তর্গুরু হিসেবে গ্রহণ করা সবসময়ই বেশি কার্যকরী। বাস্তব জীবনে আপনার বিষয় সম্পর্কে গুরুর কোনো জ্ঞান না-ও থাকতে পারে কিন্তু ওই স্তরে তিনি সে বিষয়ে আপনার চেয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। [১৩৫]

এ নির্দেশনা অনুযায়ী কোয়ান্টাম মেথডের প্রচলনকারী মহাজাতক সাহেবই হবেন অন্তর্গুরু। তাই যদি হয় তবে অন্তর্গুরুর বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মহাজাতক সাহেবের এমন ক্ষমতা রয়েছে যাতে করে তিনি তার শিষ্যদের সকল অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত রাখতে পারেন! যে গুণ আল্লাহর থাকার কথা, সেই গুণ কোয়ান্টামের সদস্যরা তাদের গুরুজী মহাজাতকের হাতে অর্পণ করছেন – কী নির্মম ধরণের শিরক এটি!

কোয়ান্টাভঙ্গি

কোয়ান্টাভঙ্গি নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছিলাম যে, এটির উৎপত্তিস্হল মোটেই ইসলাম নয়। হিন্দু বৌদ্ধ ধর্ম থেকে আগত এই উপাসনার ভঙ্গির সাথে ইসলামের কোনই সম্পর্ক নেই। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন অবশ্য এর জ্যোতিষশাস্ত্রীয় ব্যখ্যা দিতে সমর্থ হলেও কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে ইসলামী কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। যদিও একটা মনগড়া ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে যে, এই ভঙ্গি করলে হাতের মাঝে আরবীতে “আল্লাহু” লেখা হয়ে যায়। কিন্তু কুরআন বা হাদীসানুযায়ী এর কোন সত্যতা নেই, আল্লাহতা’লা আমাদের এই ভঙ্গিতে কোন ইবাদত করতে আদেশ/উৎসাহ দেননি, রাসুল (স) ও এই ভঙ্গিতে কোন ইবাদত করেননি কিংবা তাঁর সাহাবীদের করতে বলেননি। এটা পুরোপুরি কুফর ধর্ম থেকে আসা একটা উপাসনা/তপস্যা পদ্ধতি। মুসলমানদের জন্য ইবাদত করার ভঙ্গি কি হবে তা নিয়ে প্রচুর হাদীস রয়েছে। এরকম একটি হাদীস হচ্ছে –

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করল। অতঃপর রাসূলের নিকটে এসে তাকে সালাম করলে রাসূল তার সালামের উত্তর দিলেন এবং বললেন— তুমি ফিরে যাও, এবং পুনরায় সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। অতঃপর লোকটি সালাত আদায় করল। সালাত শেষে রাসূলের কাছে এসে তাকে সালাম জানাল। রাসূল সা. এবারও বললেন, তুমি আবার ফিরে যাও, এবং সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। এভাবে তিনি তিনবার বললেন। লোকটি বলল, যে সত্তা আপনাকে সত্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ ! আমি এর চেয়ে উত্তমরূপে আদায় করতে সক্ষম নই। সুতরাং আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি এরশাদ করলেন, যখন তুমি সালাতে দণ্ডায়মান হবে, প্রথমে তাকবীর দেবে। অতঃপর কোরআন থেকে তোমার জন্য সহজ—এমন কিছু পাঠ করবে। এরপর ধীরস্থিরভাবে রুকু করবে, এবং সোজা হয়ে দণ্ডায়মান হবে। তারপর সেজদারত হবে মগ্ন হয়ে, এবং সোজা হয়ে বসবে। পুনরায় সেজদায় গমন করবে, পূর্বের মত ধীরস্থিরভাবে। এভাবে তুমি তোমার সালাত সমাপ্ত করবে।[১৩৭]

ইসলামের কোথাও এই কোয়ান্টাভঙ্গি বা কোয়ান্টাসংকেত বা কোয়ান্টাধ্বনি নিয়ে কিছু বলা নেই, এমনকি এগুলোকে সমর্থন করে এরকম কিছুও কুরআন-হাদীসে উল্লেখ নেই। তবে অন্যান্য ধর্মে (বিশেষ করে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম) এই মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়, মূলত সেসব ধর্মের ধ্যান, উপাসনা, তপস্যা ইত্যাদি কাজেই এই মুদ্রা ব্যবহৃত হয়।[১৩৮]

যাকাত ফান্ড

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যাকাত ফান্ডের মাধ্যমে যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে তা বিতরণ করে। এক্ষেত্রে তারা অমুসলিমদের মাঝেও যাকাত বিতরণ করে। এটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? ইসলামে যাকাতের আটটি খাত সম্পর্কে আল্লাহতা’লা সুরা আততাওবা’র ৬০তম আয়াতে বলেন-

সাদকা (এখানে যাকাত) তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট (যাকাত আদায় ও বিতরণের সাথে যুক্ত) কর্মচারীদের জন্যে, যাদের অন্তর (ইসলামের জন্য) আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্যে, দাসমুক্তির জন্যে, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্যে। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞামায়।

এ সম্পর্কে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা আছে –

>> ভিন্নধর্মী, পাহাড়ি, ধর্মহীন কাউকে যাকাত দেয়া যাবে কি-না?
>> মহান আল্লাহ যাকাত ব্যয়ের যে ৮টি খাত নির্দিষ্ট করেছেন তাতে ফকির-মিসকিন বলা আছে। ঈমানদার ফকির-মিসকিন বলা হয় নি। [১৩৯]

অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বলছে যে যেহেতু কোথাও ঈমানদার ফকির মিসকিনের কথা বলা হয়নি তাই ভিন্নধর্মী বা ধর্মহীনদের যাকাত দেয়া যায়। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস পর্যালোচনা করে ইসলামিক পন্ডিতগণের দেয়া মতামত অবশ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সাথে একেবারেই মিলেনা। তাঁদের মতে – যাকাত একটি ফরজ ইবাদত এবং একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমকে যাকাত দিবে। যদি আপনার আশপাশে বা পরিচিত কোন মুসলিমদের মাঝে যাকাত গ্রহনের মত কেউ না থাকে তবে সেক্ষেত্রে অমুসলিমদের যাকাত দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ একজন মুসলিমের যাকাত পাবার হক সবচেয়ে বেশি এবং সে-ই যাকাত পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।[১৪০][১৪১][১৪২] এবং এরকম যাকাত পাবার মত মুসলমান আমাদের চারপাশেই প্রচুর পরিমানে রয়েছে। তার মানে এই নয় যে অমুসলিমদের দান করা যাবেনা। ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং সবাইকে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে থাকার জন্য ইসলামে বিভিন্নভাবে দান করাকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এরকমই একটা ব্যবস্থা হচ্ছে সাদকা। যাকাত হচ্ছে সবচেয়ে কম পরিমানের একটা দান যেটা করা আল্লাহতা’লা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন এবং এটা কেবল মুসলিমদের জন্যই। আর সাদকা হচ্ছে ঐচ্ছিক দান যা সবাইকেই দেয়া যায়। অমুসলিমদের সাদকা দেয়া যেতে পারে।[১৪৩][১৪৪]

অতএব আপনি যদি আপনার মুসলিম কোন ভাইকে বঞ্চিত করে ভিন্নধর্মী বা ধর্মহীন কাউকে যাকাত দিয়ে ফেলেন, ইসলামিক বিদ্বানদের মতানুযায়ী সেক্ষেত্রে আপনার যাকাত আদৌ আদায় হবেনা। তাই যাকাত দেবার ক্ষেত্রে আমাদের আগে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনদের বিবেচনা করতে হবে, এবং আমাদের মত গরীব দেশে এরকম মুসলিম ভাই-বোন এতবেশি পাওয়া যায় যে যাকাত দিয়ে কূল পাবার কথা না। একটু চোখ মেলে তাকান, আপনার আশপাশেই এরকম প্রচুর দরিদ্র মুসলিম যাকাত গ্রহীতা পেয়ে যাবেন।

সকল ধর্মই এক

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ইসলাম নিয়ে খুব কথা বললেও তারা মনে করে যে সকল ধর্মই এক। যে কারণে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আল্লাহ’র কাছে শুক্রিয়া আদায় করা আর হিন্দুদের হরি ওম বলার মাঝে কোন পার্থক্য দেখেনা –

সকালে ঘুম ভাঙতেই বলুন, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ/ হরি ওম!/ থ্যাংকস গড বা প্রভু আমি কৃতজ্ঞ নতুন একটি দিনের জন্যে’। [১৪৫]

তাদের কাছে যে সকল ধর্মই সমান এটা অবশ্য তাদের বিভিন্ন কাজ কর্মেও বোঝা যায়। যেমন তারা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বাণীও প্রচার করে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি বেদ[১৪৬], গীতা[১৪৭], ধম্মপদ[১৪৮] ও বাইবেলের[১৪৯] বাণীও প্রচার করে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন বিশ্বাস করে যে শুধু কুরআন-হাদীসই একজনের জন্য যথেষ্ট নয়, অন্যান্য ধর্ম থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এইখানেই মূল সমস্যা, কারণ ইসলাম আসার পর বাকী সব ধর্ম বাতিল হয়ে গেছে। ইসলামই যে একমাত্র জীবনব্যবস্থা তা জানাবার জন্য আল্লাহতা’লা বিদায় হজ্জ্বের মাঠে নিচের দুটি আয়াত নাযিল করেন-

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। [১৫০]

আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। [১৫১]

অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের কোন কিছু নেয়া যাবেনা বা অনুসরণ করা যাবেনা, যদি এরকম কেউ করেও থাকে তবে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হবে। এই চিন্তাটা “আপাতঃ দৃষ্টিতে” খুব সাম্প্রদায়িক এবং অসহিষ্ণু মনে হলেও করার কিছু নেই। কারণ ইসলামের এই ‘Salvific Exclusivity’ (পরলৌকিক মুক্তি শুধুই ইসলামের প্রকৃত অনুসারীদের জন্য) তে বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের একটি অংশ।

আসলে সকল ধর্মের মর্মকথা একই – পার্থক্য শুধু অভিব্যক্তিতে বা বাহ্যিক প্রকাশে বা rituals-এ” – এই কথা যদি সত্যি হত, তবে মুহাম্মদ (স)-এঁর মিশনের কোন প্রয়োজনই ছিল না । মক্কার পৌত্তলিকরা সবাই আল্লাহ মানতো – আবু জাহেল, আবু লাহাব সবাই আল্লাহয় বিশ্বাস করতো – কথায় কথায় আল্লাহকে নিয়ে শপথ করতো ৷ কিন্তু তবু আমরা তাদের কাফির ও মুশরিক বলে থাকি এবং কাফির ও মুশরিকের সাথে কিছুতেই মুসলিমদের প্রেম-প্রীতি, সহ-অবস্থান, সামাজিকতা বা নির্বিচার মেলামেশা যে সম্ভব নয়, সে কথা পবিত্র কুর’আনের বহু আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। রাসূল (স)- এঁর বহু হাদীসেও মুসলিমদের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কোন মতবাদ যদি তাকে এই দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে বলে যে, সকল ধর্মই এক বা কোন কাজ করতে বলে যা অন্য কোন ধর্মের ইবাদাতের অংশ হিসেবে প্রমাণিত বা কোন কাজ যে অনুমোদিত তা বোঝানোর জন্য অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ থেকে রেফারেন্স দেয়া হয় বা অন্য কোন ধর্মের প্রবাদপুরুষ কাউকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে আপনাকে পথভ্রষ্টতার দিকে ডাকছে। হযরত উমর (রা) একবার তাওরাত কিতাবের কিছু পৃষ্ঠা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিলেন, সেটা দেখে রাসুল (স) তাঁকে তিরস্কার করেন আর বলেন যে, মূসা (আ) বেঁচে থাকলে, তাঁরও মুহাম্মদ (স) কে অনুসরণ করা ছাড়া কোন উপায় থাকতো না –

It was reported that the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) became angry when he saw that ‘Umar had a page with something from the Tawraat written on it, and he (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “Are you in doubt, O son of al-Khattaab? Have I not brought you something shining and pure? If my brother Moosa were alive, he would have no choice but to follow me.” (Narrated by Ahmad and al-Daarimi, and others).[১৫২]

তাই অন্য কোন ধর্মের রীতি-নীতি কিংবা ধর্মগ্রন্থের বাণী আমাদের কাছে যত সুন্দরই লাগুক না কেন, সেগুলো গ্রহণ করার কোন উপায় নেই। যেখানে হযরত উমর (রা) এর মত শ্রেষ্ঠ মুসলিমদের একজনেরও আহলে কিতাবদের তাওরাতে কিছু খোঁজ করার অধিকার নেই – সেখানে “ভগবত গীতা” বা “বেদ”-এর তো প্রশ্নই ওঠে না! কাফির ধর্মে আমাদের জন্য কিছুই নেই। আর যে কাফিরদের কাফির মনে করেনা সে নিজেই কাফিরদের দলগত হয়ে যায়।[১৫৩] কারণ রাসূল (সা) বলে গেছেন যে, কোন গোষ্ঠীর অনুকরণ করবে, সে তাদেরই একজন বলে গণ্য হবে –

It was narrated that ‘Abd-Allaah ibn ‘Umar said: The Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “Whoever imitates a people is one of them.” [১৫৪]

তাহলেই বলুন কোন ন্যূনতম মুসলিমও কি হিন্দু/বৌদ্ধ ঋষি বা সাধুদের অনুকরণ করতে পারে? চিন্তা করে দেখুন তো আন্তঃধর্ম মেলবন্ধন কিংবা সকল ধর্ম একই – এই ব্যাপারটা আপাতঃদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও তা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত সাবধানবাণী অনুযায়ী আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে? নিশ্চয়ই কুফরের অন্ধকারে।

কোয়ান্টাম মেথডের কর্মকান্ডগুলো কিভাবে ঘটে?

কমান্ড সেন্টার, অন্তর্গুরু, ভবিষ্যৎদৃষ্টি – এই যে বিষয়গুলো কোয়ান্টাম মেথডের সাথে জড়িত, তার বাস্তব সংঘটনের কথা তো অস্বীকার করা যায় না। কারন অনেকের সামনেই এগুলো ঘটেছে। কিন্তু আসলে কিভাবে এগুলো ঘটে? এর ব্যাখ্যাও রয়েছে। এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে আমাদের জানতে হবে জ্বিনদের সম্পর্কে।

Many shaykhs appear to levitate, travel huge distances in split instants of time, produce food or money from nowhere etc. Their ignorant followers believe these feats of magic to be divine miracles. But behind all of these phenomena lie the hidden and sinister world of the jinn. They are able to travel over vast distances instantaneously and enter human bodies prepared for entry. In many Christian and pagan sects people work themselves into a physical and spiritual frenzy, fall into a state of unconsciousness. In that weakened state the jinn may easily enter their bodies and cackle on their lips. This phenomenon has also been recorded by some sufi orders during their dhikr. Information about the past of an unknown person can easily be put into the subconscious mind by the jinn. [১৫৫]

এ থেকে এটা পরিস্কার যে মেডিটেশনের ধাপগুলো আসলে জ্বিনদের সাহায্য অর্জনের প্রক্রিয়া মাত্র। এই বিষয়ে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক পড়াশোনা থাকলেই আমরা কমান্ড সেন্টারে অপরিচিত মানুষদের ব্যাপারে না দেখেই কীভাবে পুংখানুপুঙ্খ বিবরণ দেয়া হয় তা বুঝতে পারব। যাকে অন্তর্গুরু হিসেবে চাওয়া হচ্ছে তাকে কিভাবে দেখা যাবে তাও বোঝা যাবে। বিজ্ঞানমনস্ক অনেকেই হয়তো এই ব্যাপারটাকে আমলে নিবেননা, অনেকেই হয়তো জ্বিনদের অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বাসই স্থাপন করবেননা, কিন্তু যেখানে কুরআনে স্বয়ং আল্লাহতা’লা জ্বিনদের কথা বলেছেন সেখানে কোন অবিশ্বাসের সুযোগই নেই।

ইসলাম থেকে পথভ্রষ্টতার পথে

একজন মুসলিমকে ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে কাফিরদের পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাবার জন্য অনেক ধরণের কাজ রয়েছে। শায়েখ মুহাম্মাদ ইবন আব্দ আল ওয়াহাব[১৫৬] সহ বিভিন্ন ইসলামি বিদ্বানরা এদের মধ্য থেকে ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টকারী দশটি সবচেয়ে সূক্ষ্ম কিন্তু মারাত্মক কাজকে[১৫৭] আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো হল –

    ১। আল্লাহর সাথে শিরক করা
    ২। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে কাউকে মাধ্যম হিসেবে মান্য করা এবং এটা বিশ্বাস করা যে তার দ্বারা সহজেই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানানো যায়
    ৩। কাফিরকে কাফির মনে না করা
    ৪। অন্য কোন ব্যক্তির শিক্ষাকে রাসুল (স) এর শিক্ষার চেয়েও বেশি ফলপ্রসু বা ভালো মনে করা
    ৫। রাসুল (স) মানব জাতির জন্য যে নির্দেশনা এনেছেন সেটা বা তার কোন অংশকে ঘৃণা বা অপছন্দ করা
    ৬। রাসুল (স) এর উপর অবতীর্ণ ধর্ম নিয়ে কোন ধরণের কৌতুক বা মজা করা
    ৭। জাদু-টোনা করা বা জাদু-টোনা করা সমর্থন করা
    ৮। মুশরিকদের সমর্থন দেয়া এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা
    ৯। কিছু লোক রাসুল (স) এর ধর্মের উর্ধ্বে ফলে তারা রাসুল (স) এর নিয়ম বহির্ভূত যে কোন কিছু করার অধিকার রাখেন – এমনটা বিশ্বাস করা
    ১০। আল্লাহতা’লার ধর্ম ইসলাম থেকে সরে আসা কিংবা ইসলাম সম্পর্কে কোন কিছু জানতে বা শিখতে না চাওয়া

উপরের কেবল এই দশটি কাজের তালিকা থেকে কোয়ান্টাম মেথড এর মাধ্যমে আমরা কিভাবে ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়তে পারি তা দেখা যাক।

কোয়ান্টাম মেথড আমাদের শেখায় – আমরা সব পারি, সকল ক্ষমতার উৎস আমার মন, ধ্যানের মাধ্যম সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, প্রকৃতির নেপথ্য শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, অন্যকে অসুখ হতে সারিয়ে তুলতে পারি, ভবিষ্যতের টেন্ডারের দাম দেখতে পারি (অর্থাৎ গায়েব জানতে পারি) ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর গুনাগুণ মানুষের উপর আরোপ করার নামই শিরক, শিরক কেবল মূর্তি বানিয়ে পূজা করার নাম নয়, শিরক হচ্ছে তৌহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা! সেক্ষেত্রে উপরের ১ নম্বর ঈমান বিনষ্টকারী পয়েন্ট অনুযায়ী আমাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

কেউ যদি প্রার্থনার জন্য বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য অন্য কাউকে এজেন্সি মনে করে, তবে উপরের তালিকার ২ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী তার ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোয়ান্টাম মেথড-এর অতিরিক্ত গুরুভক্তি বা ধ্যানাবস্থায় অন্তর্গুরুর হাতে সব সমর্পন করা এই ২ নম্বর পয়েন্টের মধ্যে পড়ে যায় যাতে আমাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

কোয়ান্টাম মেথড কাফিরকে কাফির মনে করেনা। তাই তারা কাফির ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি (ধ্যান) ইসলাম ধর্মে নিয়ে আসে কিংবা তাদের ধর্মের সাথে ইসলামকে একই অবস্থানে (কুরআনের পাশাপাশি বেদ, গীতা, বাইবেল ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের বাণী প্রচার ও অনুসরণ) নিয়ে আসে। এর ফলে উপরের তালিকার ৩ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

কোয়ান্টাম মেথড ধ্যান করাকে উৎসাহ দিচ্ছে, অন্য ধর্মের মতাদর্শ প্রচার করছে। অন্য ধর্মের প্রচারকরা (যেমন গৌতম বুদ্ধ) যা করেছেন (অর্থাৎ ধ্যান, অভয়মুদ্রা ইত্যাদি) তা অনুসরণ ও অনুকরণ করা শেখানো হচ্ছে, যা কীনা প্রকারান্তরে রাসূল (স) আমাদের যে জীবন বিধান দিয়ে গেছেন, তাকে অসম্পূর্ণ মনে করা বা অন্য কিছুকে তার চেয়ে শ্রেয় মনে করার শামিল। ফলে উপরের তালিকার ৪ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী কোয়ান্টাম মেথড আমাদের ঈমান হারানোর আশঙ্কায় ফেলে।

উপরের ৭ নম্বর পয়েন্টের আওতায় তন্ত্র-মন্ত্র (কোয়ান্টা ধ্বনি), তাবিজ-কবজ (অষ্টধাতুর তৈরি কোয়ান্টাম বালা, কোয়ান্টাম মেথডের মতে যা কারো কারো দেহের মেটালিক বা ধাতুগত ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক[১৫৮]), রাশিতে বিশ্বাস[১৫৯], ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা অর্থাৎ আইচিং[১৫৯], জ্যোতিষ-শাস্ত্র বা ধ্যানের আসনে বৃহষ্পতি শনি ইত্যাদির আবির্ভাব – সবই এসে যাবে। এখানেও আমরা কোয়ান্টাম মেথড এর মাধ্যমে ঈমান হারানোর আশঙ্কায় থাকবো।

উপরের ৯ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী কেউ যদি মনে করে যে, বিশেষ কারো জন্য শরীয়াহ্ প্রযোজ্য নয় (শিশু, পাগল, ঘুমন্ত ব্যক্তি – এরকম কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) বা বিশেষ কেউ শরীয়তের ঊর্ধ্বে – তাহলে যিনি এমন মনে করবেন তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, কোয়ান্টাম মেথডের প্রচলনকারী মহাজাতক সাহেব মহিলাদের মাথায় হাত রাখেন (ইউটিউবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের যেকোন পুনর্মিলনী ধরণের অনুষ্ঠান দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়) কিংবা কোয়ান্টামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সামনেই অনেক মহিলা যথাযথভাবে পর্দা না করে থাকে বা কোয়ান্টাম লামা সেন্টারের বিভিন্ন প্রাণীর মুর্তি-ভাস্কর্য স্থাপন করা[১৬০] ইত্যাদি ব্যাপারগুলো ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন যে, মহাজাতক সাহেব এসব শরীয়তের ঊর্ধ্বে, তার বেলায় শরীয়তের চিরাচরিত নিয়মগুলো খাটবেনা, তিনি এসব করতেই পারেন – তবে যে এরকম ভাববে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানেও কোয়ান্টাম মেথড এর মন্ত্রণায় আমাদের ঈমান হারাতে পারে।

উপরের ১০ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী যারা দ্বীন শিখে না বা দ্বীনের প্র্যাক্টিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা কাফির বলে গণ্য হতে পারে। কোয়ান্টাম মেথড তো আমাদের শর্টকাট শিখিয়ে দিচ্ছে – এমনও বলছে যে কোন আল্লাহতা’লাকে বিশ্বাস না করলেও আমরা চূড়ান্তভাবে সফল হতে পারি[১৬১][১৬২]। এখানেও আমরা ঈমান হারানোর আশঙ্কায় রয়েছি। আমরা যারা কোয়ান্টাম মেথড এর শরণাপন্ন হয়েছি, তারা কি নিজের দ্বীন শেখার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি? নিজের দ্বীন না শিখে আমরা কি নিজেদের পথভ্রষ্টতার রাস্তায় নিয়ে যাইনি? আমরা কি ইসলামী শরীয়াহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই নি?

আপনি যদি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দেখানো পথে চলেন তবে উপরের ঈমান হারাবার কাজের তালিকার ১০ টি কাজের মধ্যে ৭টি কাজই আপনি সংঘটিত করেছেন। যেখানে একটি কাজ করলেই আপনার ঈমান হুমকির সম্মুখীন সেখানে সাত-সাতটি কাজ আপনি করেছেন বা করছেন। চিন্তা করে দেখুন তো ব্যাপারটা কতটুকু গুরুতর!

উপসংহার

তাহলে উপরের আলোচনা হতে আমরা দেখলাম যে কোয়ান্টাম মেথড এর সাথে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। ওরা বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান ব্যবহার করে আসছে আর পুরো ব্যাপারটা সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য “সায়েন্স অফ লিভিং” টার্মটা ব্যবহার করছে। তাছাড়া ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখলাম যে কোয়ান্টাম মেথড প্রকৃতপক্ষে একইসাথে বিদআত, কুফর ও শিরকের চর্চা করে আসছে। যেখানে বিদআত, শিরক ও কুফর – এ তিনটির যেকোন একটি সংঘটিত হলেই ইসলাম থেকে নাম খারিজ হয়ে যায়, সেখানে একই সাথে তিনটি গুনাহ হচ্ছে – কী ভয়াবহ কথা!

আমরা আসলে ইসলামবিহীন মুসলিম, যারা নিজের দ্বীন জানিনা বলে “ঈমান” এবং “কুফরের” সীমা রেখা চিহ্নিত করতে জানি না – তাই সমানে দুই ভুবনে যাতায়ত করতে পারি – মনে করি হিন্দুদের বা বৌদ্ধদের ধর্মীয় উপসনা/তপস্যা করেও আমরা তথাপি মুসলিমই থাকতে পারি (নাউযুবিল্লাহ্)। আচ্ছা, একটু ভেবে বলুন তো, একজন মানুষ কি একই সময়ে “অযু” এবং “অযু বিহীন” অবস্থায় থাকতে পারে? পারে না, তাই না! অযু ভঙ্গের যে কোন একটি কারণ ঘটে গেলে তাকে পুনরায় অযু করতে হবে! ধরুন কেউ জানে সে কিভাবে অযু করবে, কিন্তু সে জানে না কিসে অযু ভঙ্গ হয় – তাহলে কি এমন সম্ভাবনা থাকবে না যে, তার আসলে কখনো হয়তো অযু ভেঙ্গেই গিয়েছে, কিন্তু সে ভাবছে, “তার অযু তো আছেই” এবং সে সালাত আদায় করে চলেছে – অথচ, তার সালাত অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে! একই ভাবে একজন মানুষ একই সাথে “ঈমান” এবং “কুফরে” থাকতে পারে না। ঈমান রক্ষা করতে হলে তাকে জানতেই হবে যে কিসে কিসে ঈমান ভঙ্গ হয়। আর ঈমান ভঙ্গ হলেই সে কাফিরদের কাতারে গিয়ে পড়বে। সারা জীবন নামায-রোযা করেও ক্বিয়ামতের দিন “কাফির” বা “মুশরিকের” কাতারে দাঁড়াতে হতে পারে এবং চির-জাহান্নামী হিসেবে জাহান্নামে যেতে হতে পারে!

তাহলে আমাদের করণীয় কি? এক কথায় যদি আমাদের করণীয় বলতে হয়, তবে তা হল দ্বীন শিক্ষা করা। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে দ্বীন শিক্ষার রাস্তা কোন কালেই মসৃণ ছিলনা। তাবে-তাবেঈদের মত আমাদের হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই করতে দিনের পর দিন লোকজনের দরজায় গিয়ে গিয়ে কড়া নাড়তে হবেনা বা উটের পিঠে চড়ে মাসের পর মাস ভ্রমণ করতে হবেনা। আজকের অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মাউস ক্লিক করে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা যেমন সম্ভব তেমনি তা সহীহ কিনা সেটাও যাচাই করা সম্ভব। আর সেই সাথে অবশ্যই কৃত কাজের জন্য আমাদের আল্লাহতা’লার কাছে মাফ চাওয়া উচিৎ, আসলে “উচিৎ” বললে কম বলা হয়ে যায়, বলা দরকার “অবশ্য কর্তব্য”। কারণ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের পথে চলতে গিয়ে আমরা যেভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছি বা যাচ্ছি, তাতে আল্লাহতা’লা ছাড়া আর কেউ নেই যে আমাদের পরকালের আযাব থেকে রক্ষা করবে। আল্লাহতা’লা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমার এই লেখাটি পরে যদি আপনার সামান্যতম উপকারও আমি করতে পারি তবেই আমার সকল শ্রম সার্থক হবে।